বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর মূল্যায়ন করেছে। তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী আটটির মধ্যে দুটি ‘বাস্তবায়ন’, তিনটি ‘অর্থ সংগ্রহ’, দুটি ‘প্রস্তুতি’ এবং একটি ‘চিহ্নিতকরণ’ পর্যায়ে রয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সার্বিকভাবে সন্তোষজনক নয় এবং বাস্তবায়নের দিক থেকে অন্য প্রকল্পগুলোর চেয়ে এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না।
Published in Prothom Alo on Friday, 16 October 2015.
দ্রুত বাস্তবায়িতব্য প্রকল্প
নামে দ্রুততম, বাস্তবে ধীরগতি
ফখরুল ইসলাম সরকারের হাতে নেওয়া আটটি বড় প্রকল্পের বেশির ভাগেরই কাজ চলছে ধীরগতিতে। যদিও প্রকল্পগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়িতব্য বা ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’।
আট প্রকল্পের মধ্যে চারটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের, যার মধ্যে তিনটিই আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। বাকি চারটি অবকাঠামো খাতের; অর্থাৎ পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
এগুলোর ছয়টি বাস্তবায়নে ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বাকি দুটির নির্মাণব্যয় এখনো ঠিক হয়নি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে, আট প্রকল্পে বাস্তবায়ন ব্যয় আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মোট বাজেটের সমান।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ অবস্থা বিশ্লেষণ করেছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজই এগিয়ে রয়েছে। বাকিগুলো চলছে ধীরগতিতে।
এর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল নির্মাণ কেন্দ্র আগামী দুই বছর, পদ্মা বহুমুখী সেতু তিন বছর এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট (মেট্রোরেল), মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা বন্দর আট বছর এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ৩৫ বছরে বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। অবশ্য পায়রা বন্দর, সোনাদিয়া বন্দর এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের প্রস্তাব জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতেই (একনেক) অনুমোদিত হয়নি।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, এই আটটি প্রকল্প হবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে গতি সঞ্চালক প্রকল্প। এর মধ্যে পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের চলতি মেয়াদেই (২০১৯ সাল) শেষ হবে।
আটটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জিডিপিতে কত শতাংশ অবদান বাড়বে—এ বিষয়ে সরকারের কোনো প্রাক্কলন নেই। তবে বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেই জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বছরে শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ বাড়বে এবং অনগ্রসর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে।
প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম তদারক করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দিকটি প্রধানমন্ত্রী খুব গুরুত্বের সঙ্গে নজরদারি করছেন। সাদা চোখে দেখা না গেলেও প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুতই এগিয়ে চলছে।
দ্রুত বাস্তবায়িতব্য প্রকল্প:ছয় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা, এর তিনটি প্রকল্প এখনো একনেকে অনুমোদিত হয়নি, বাস্তবায়নে এগিয়ে শুধু পদ্মা বহুমুখী সেতু
উদাহরণ দিয়ে মুখ্য সচিব বলেন, ‘পদ্মা সেতুর কাজ চলছে কয়েক বছর থেকেই। কিন্তু কাজ দৃশ্যমান হয়েছে মাত্র এক বছর। বাকিগুলোর অবস্থা এ রকমই, শুরু হয়ে গেলে শেষ হতে সময় লাগবে না।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর মূল্যায়ন করেছে। তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী আটটির মধ্যে দুটি ‘বাস্তবায়ন’, তিনটি ‘অর্থ সংগ্রহ’, দুটি ‘প্রস্তুতি’ এবং একটি ‘চিহ্নিতকরণ’ পর্যায়ে রয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি সার্বিকভাবে সন্তোষজনক নয় এবং বাস্তবায়নের দিক থেকে অন্য প্রকল্পগুলোর চেয়ে এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। পায়রা থেকে সোনাদিয়ার দূরত্ব বেশি না থাকায় অগ্রাধিকার ঠিক করা এবং মাতারবাড়ী প্রকল্পটি সমুদ্রের কাছে হওয়ায় ভারী স্থাপনা নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে সিপিডি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। সংস্থাটির পরামর্শ হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) এগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা।
পদ্মা সেতু: বহুল আলোচিত এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেতু বিভাগ। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলে সরকার নিজেই পদ্মা সেতু নির্মাণে হাত দেয়। ৯২ শতাংশ সরকারি ও ৮ শতাংশ ভারতীয় অনুদানের এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালে। গত ১৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পটির ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত ব্যয়ের হিসাব ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ সূত্র বলছে, নির্মাণব্যয় বেড়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা হয়েছে।
প্রকল্পটির নদীশাসন কাজের জন্য ড্রেজার, অ্যাংকর বোট, ট্যাগবোট, জাহাজ, কনটেইনার, যন্ত্রপাতি কেনাসহ ৮ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। তবে জাজিরা সংযোগ সড়ক ও মাওয়া সংযোগ সড়কের কাজ হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন কার্যক্রম ও পরিবেশ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা সরকারি ব্যয় ও ৪ হাজার কোটি টাকা প্রকল্প সাহায্য। ২০১৭ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা।
প্রকল্প বাস্তবায়নে রাশিয়ার ঠিকাদার অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে এযাবৎ তিনটি চুক্তি হয়েছে পরমাণু শক্তি কমিশনের। অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট হচ্ছে রাশিয়ান স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের (রোসাটম) অধিভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম ও দ্বিতীয় চুক্তির শতভাগ এবং তৃতীয় চুক্তির ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন হবে চতুর্থ চুক্তি।
মেট্রোরেল: এর আওতায় রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ১৬টি স্টেশন থাকবে। উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও হোটেল মোড়, শাহবাগ জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম এবং সবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রকল্প ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মধ্যে সরকারি অংশ ৫ হাজার ৩৯০ কোটি ও জাপানের সাহায্য ১৬ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পটির জন্য রাজউক এরই মধ্যে ৫৮ দশমিক ৯১ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে। মূল কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর: কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের এই প্রকল্পের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে ২০০৯ সালে। তিন ধাপে ৩৫ বছরে (২০১৫-২০৫০) বাস্তবায়নযোগ্য এতে পোতাশ্রয় হবে ছয়টি; প্রতিটির আয়তন হবে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের তিন গুণ। ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।
প্রকল্পটির অর্থায়ন বিষয়ে মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, উন্নয়ন-সহযোগী দেশ ও সংস্থা থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন ও মালয়েশিয়া অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছে।
পায়রা বন্দর: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার রাবনাবাদ চ্যানেলে এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২৫ সালে এটি শেষ করার কথা। ব্যয় হবে ১ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ড্রেজিং কার্যক্রম, যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে যে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছে, তা প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি বা পিইসি অনুমোদন করেছে। কাজল ও তেঁতুলিয়া নদীতে জরিপকাজও করেছে নৌবাহিনী।
নৌসচিব শফিক আলম মেহেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু পায়রা নয়, সোনাদিয়ার প্রস্তাবও একনেকে উপস্থাপনের প্রস্তুতি চলছে।’
মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র: সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণের জন্য এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। ৩০ শতাংশ ব্যয় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ এবং ৭০ শতাংশ ঋণ নেওয়া হবে। প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালে। ৬৬০ মেগাওয়াট করে দুটি আলাদা বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সরকারের লক্ষ্য।
পশুর নদীর তীর ঘেঁষা এই প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছু অংশে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ১০ কোটি টাকা দিয়েছে।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে জানান, প্রকল্পটি এগোচ্ছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর দরপত্রে তিনটি অবেদন জমা পড়েছে।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র: কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নে ৬০০ করে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বিদ্যুৎ বিভাগ। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালে। প্রকল্প ব্যয় ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা, যার বেশির ভাগই দেবে জাপান। গত অর্থবছরে এই প্রকল্পের জন্য ২৬৮ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, রামপালসহ কয়েকটি একটু ধীরগতির হলেও তাঁর মন্ত্রণালয়ের বাকিগুলো দ্রুতই এগোচ্ছে।
এলএনজি টার্মিনাল: এই প্রকল্পও হবে মহেশখালীর উপকূলে। দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন এই টার্মিনাল থেকে মূল ভূখণ্ডে গ্যাস আনতে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার পাইপলাইন বসাতে হবে। পেট্রোবাংলার প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) টার্মিনাল নির্মাণের জরিপের কাজ শেষ করেছে মাত্র। প্রাথমিক কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, দাখিলের শেষ দিন ছিল ৪ অক্টোবর। প্রকল্পটির নির্মাণব্যয়ই ঠিক হয়নি।
অথচ এবারের বাজেট বক্তৃতায়ও অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে এলএনজি আমদানি করে গ্যাস সরবরাহের কাজ শুরু করা যাবে।