CPD study on hartal cited in a report published in Bangladesh Pratidin on Wednesday, 7 January 2015.
রুহুল আমিন রাসেল
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের ডাকা লাগাতার অবরোধে গভীর উৎকণ্ঠায় ব্যবসায়ীরা। এ কর্মসূচির ফলে সংঘাত-সহিংসতা ও নাশকতার ভয়ে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। সময়মতো শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি কর্মস্থলে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ব্যবসায়ী নেতারা অবরোধ বন্ধের দাবি জানিয়ে বলেছেন, ‘দেশের মানুষের শ্রমে আর ঘামে তিল তিল করে গড়ে ওঠা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করবেন না। দেশে বর্তমানে যে শান্তি বিরাজমান আছে, তা আগামীতেও অব্যাহত রাখুন।’ তারা আরও বলেছেন, অর্থনীতি অবরোধের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে ভারী শিল্পসহ অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। লোকসানের মুখে পড়ছেন উদ্যোক্তারা। কমে যাচ্ছে কর্মসংস্থান, শিল্পের উৎপাদন। বিশেষ করে আবাসন, মৎস্য উৎপাদন, পোলট্রি এবং কৃষি খাত অবরোধের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মতে, ২০১৩ সালের হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতায় ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হন। তবে ২০১৪ সালে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসায় ব্যবসায়ীরা সেই ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। এমন অবস্থায় হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি অর্থনীতির জন্য আÍঘাতী। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ অবরোধ বন্ধের দাবি জানিয়ে গতকাল মক্কা থেকে টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধ ও নাশকতা করে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করা হচ্ছে। এটা রাজনীতি নয়।’ তিনি রাজনীতিবিদদের অর্থনীতি ধ্বংস না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট করে অর্থনীতি গড়ে তুলেছি। আপনারা এই অর্থনীতি ধ্বংস করবেন না।’ তার মতে, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে গত বছর যদি বিএনপি নেত্রী সংলাপে রাজি হতেন, তাহলে এখন এই সমস্যা হতো না। এফবিসিসিআইয়ের তরফ থেকে আরও বলা হয়েছে, বছরের শুরুতে অবরোধ কর্মসূচির কারণে জাতীয় অর্থনীতির পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরীক্ষা বন্ধ হলে শিক্ষার্থীরা একটি সেশন হারাবে, যা অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এ ছাড়াও বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির প্রাক্কালে মুসল্লিদের ঢাকায় আগমন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি বলেন, ‘রানা প্লাজা ঘটনা ও হরতাল-অবরোধ এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে আমাদের জন্য ২০১৩ সাল খুবই কঠিন ছিল। অনেক কষ্টের পর ২০১৪ সালে পোশাকশিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন আমরা ২০১৫ সালে ফসল ভোগ করতে চাই।’ পোশাকশিল্প হরতালের আওতামুক্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগে হরতালে পোশাকশিল্পের পণ্য পরিবহন করা যেত। কিন্তু এখন হরতাল-অবরোধে পণ্য পরিবহন তো দূরের কথা, পণ্যের নিরাপত্তা পর্যন্ত নেই। আমরা ব্যবসা করতে পারছি না। ক্রেতারা বিকল্প রপ্তানিকারক দেশ খুঁজছে। এ অবস্থায় ২০১৫ সালে হরতাল-অবরোধ অব্যাহত থাকলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য তা আÍঘাতী হবে।’ ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (আইবিসিসিআই) বিশেষ উপদেষ্টা আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘যে শান্তি গত এক বছর ছিল, তা আগামীতে অব্যাহত চাই। দেশের সব ব্যবসায়ী হরতাল-অবরোধ ও সংঘাতে উৎকণ্ঠিত। এভাবে চলতে থাকলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিশেষ করে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশ পিছিয়ে পড়বে।’ শিল্পপতিদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) প্রথম সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘অবরোধে পরিবহন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের চলাচল বন্ধ রয়েছে। পণ্যবাহী কোনো ট্রাক চলছে না। সময়মতো পণ্য পরিবহন না হওয়ায় রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে।’ প্লাস্টিক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘হরতাল-অবরোধের মতো মধ্যযুগীয় বর্বর কর্মসূচি পরিহার করে দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে হবে। হরতাল-অবরোধ খুবই খারাপ কর্মসূচি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে ২০২১ সাল ঘিরে আমাদের একটা স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। হরতাল-অবরোধ দিয়ে ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না।’ তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে হরতাল-অবরোধের বাইরে বিকল্প কর্মসূচির চিন্তা করার আহ্বান জানান। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হুমায়ন রশীদ বলেন, ‘দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো চলছে না। আমরা উদ্বিগ্ন আছি। এই উদ্বেগ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে একটা সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। যেখানে ব্যবসায়ীরা ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারব। এই পরিবেশ পেলে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কাজ করতে পারব।’ নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি এস এম আসলাম সানী বলেন, ‘ব্যবসায়ারী এখন উদ্বেগ-উৎণ্ঠার সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছেন। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধস ও রাজনৈতিক সহিংসতায় আমরা ধ্বংসের মুখে পড়েছিলাম। তখন ভাবমূর্তির সংকটও হয়। এই সংকট ২০১৪ সালে আমরা কাটিয়ে কিছুটা স্বস্তিতে ফিরেছি। হরতাল-অবরোধে পণ্য ব্যয় বেড়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে একটি স্থিতিশীল সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ চাই।’এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাব মতে, একদিনের হরতালে দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হয় তার পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। হরতালে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে আবাসন, পরিবহন, তৈরি পোশাক ও ক্ষুদ্র ব্যবসা খাত। আর সীমহীন দুর্ভোগে পড়ছেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ‘হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি’ শীর্ষক সিপিডির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে ছয় মাসে দেশে ৫৫টি হরতাল-অবরোধ হয়েছে। ওই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতি হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৮০ দিনের মধ্যে দেশে হরতাল-অবরোধ হয়েছে ৫৫ দিন। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে একদিনের হরতালের কারণে ক্ষতির পরিমাণ ৮৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পরিবহন খাতের। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৩০৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কৃষি খাত। এ খাতে একদিনের হরতালে ক্ষতি হয় ২৮৮ কোটি টাকা। বস্ত্র ও গার্মেন্ট খাতে ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ২৫০ কোটি টাকা। পর্যটন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা। পোলট্রি, কৃষি এবং আবাসন খাতের ক্ষতিও প্রতিদিনে প্রায় শত কোটি টাকার বেশি। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যমতে, একদিনের হরতালে শুধু এ খাতের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ১০৮ কোটি টাকা। হরতালের কারণে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে পোশাক খাতের ক্ষতি হয়েছে ৮০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। শুধু ১৯৯৯ সালেই ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতি বছরে ক্ষতি হয়েছে ৮ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। বর্তমান সময়ে হরতালের প্রতিটি দিনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০০০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।