Published in Manobkantho on Tuesday, 20 January 2015.
টানা অবরোধে ঝুঁকিতে দেশের অর্থনীতি
মাহফুজুল ইসলাম
রাজনৈতিক সহিংসতায় বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন দেশের অর্থনীতি। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের সঙ্গে গত ১৪ দিনে হরতাল ও অবরোধের কারণে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার। ভেঙে পড়েছে দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। পণ্য উৎপাদন করে বিক্রি করতে না পেরে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কৃষকরা। এছাড়া পোশাক শিল্প হারাচ্ছে বিদেশি ক্রেতা। এসব কারণে চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের কম হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতির সার্বিক বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মানবকণ্ঠকে বলেন, ২০১৩ সালের সহিংসতার পর গত বছর দেশে বিনিয়োগ ছিল অনেকটাই স্থবির। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও রাজস্ব আদায় হয়েছে খুবই কম। এরপর নতুন করে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় অর্থবছরে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও ঢাকা চেম্বার সূত্রে জানা যায়, অবরোধ ও হরতালে প্রতিদিন দেশের অর্থনীতিতে কেবল ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয় ১৫০০ থেকে ২০০০ কোটি টাকার। সে হিসাবে গত ১৪ দিনে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে ২১ থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকার। এফবিসিসিআইয়ের তথ্য অনুসারে, একদিনের হরতাল বা অবরোধে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অর্থাৎ পাইকারি বাজার, শপিং মল, শোরুম, ক্ষুদ্র দোকানগুলোর ক্ষতি ৬০০ কোটি টাকার, পরিবহন খাতে ৪৫০-থেকে ৬০০ কোটি টাকার, কৃষি খাতে ২৮৮ কোটি টাকার, রাজস্ব খাতে ২৫০ কোটি টাকার এবং আর্থিক খাতে ক্ষতি হয়েছে ৫০ কোটি টাকার।
এছাড়াও বীমা খাতে ক্ষতি হয় ২৫ কোটি টাকার। দোকান মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, হরতাল ও অবরোধে দিনে ক্ষতি প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, সাধারণত প্রতিদিন ৫৫০ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়। হরতালে এসব পণ্য রফতানি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
এরই মধ্যে হরতাল আর অবরোধে পোশাক খাতের বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ সফর বাতিল করতে শুরু করেছেন। কয়েকজন ক্রেতা রফতানিকারকদের নিজ দেশে ডেকে পাঠাচ্ছেন অথবা কাছাকাছি অন্য কোনো দেশে গিয়ে ক্রয় আদেশ চূড়ান্ত করতে বলছেন বলে জানিয়েছে পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট আতিকুল ইসলাম জানান, দেশের রাজনৈতিক কারণে চাহিদার তুলনায় অর্ডার ২০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিয়েছে বিদেশি ক্রেতারা। তিনি বলেন, দেশ এ অবস্থা চলতে থাকলে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি দূরে থাক, গত বছরের সমপরিমাণ রফতানি হবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় বেশি ক্ষতি হয় বীমা কোম্পানিগুলোর। গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় শুধু চলতি মাসেই ছয়শ গাড়ির বীমা পূরণ করতে হবে। তিনি বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে দেশের বীমা শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান তিনি।
প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৫ শতাংশ: নতুন সরকারে প্রথম অর্থবছর অর্থাৎ ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষের বছরে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাত দশমিক তিন শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু অবকাঠামো সমস্যা, মুদ্রা ও পুঁজিবাজারে সংস্কারের অভাবের সঙ্গে নতুন করে যোগ হওয়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশের কাছাকাছি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের রেভিনিউ কালেকশন, বেসরকারি বিনিয়োগ, রেমিটেন্স প্রবাহের গতিতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে হতো। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হওয়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে এ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে প্রবৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন এ বছর প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর তথ্য মতে প্রবৃদ্ধি অর্জন হতে পারে ছয় শতাংশের কাছাকাছি।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ শাখার প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসাইন বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছয় দশমিক দু’শতাংশ হতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। তবে আমি মনে করি এটা ছয় শতাংশের নিচে থাকবে। মূলত প্রবৃদ্ধি একটু বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থনীতির কয়েকটি ইতিবাচক সূচকের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু সেটা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কৃষকদের মাথায় হাত: শীতকালীন সবজির ভরা মৌসুম এখন। প্রান্তিক কৃষকরা বোরো ও আমনের পর সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেন সবজি উৎপাদন ও বিক্রিতে। এখান থেকে বড় ধরনের আয়ও হয় তাদের। কিন্তু উৎপাদিত সবজি তারা ১৪ দিন ধরে বাজারজাত করতে পারছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রতিদিনই কৃষককে চোখের পানি ফেলতে হচ্ছে। তারা সবজি বিক্রি করতে পারছেন না। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিদিন যেখানে অর্ধলক্ষাধিক ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান সারাদেশে পণ্য পরিবহন করে, সেখানে এখন প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে কিছু পরিবহন চলাচল করছে। এতে ভাড়াও বেশি নেয়া হচ্ছে। এতে পণ্য পরিবহন বিশেষ করে কাঁচামাল পরিবহন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
পর্যটন ব্যবসায় ধস: বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড ও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, পর্যটনের ভরা মৌসুম হচ্ছে অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। এ সময়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি, কুয়াকাটা, সিলেট, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, সুন্দরবন, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, মনপুরা ইত্যাদি এলাকা ভ্রমণ করেন। কিন্তু গত ১৪ দিনের অবরোধের কারণে ইতিমধ্যে বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণ বাতিল করেছে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় সব কটি প্রতিষ্ঠান।
এর আগে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে অর্থনীতির এ ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত রাখতে রাজনীতিবিদদের হরতাল ও অবরোধ প্রত্যাহারে আহ্বান জানানো হয়। না হলে হরতাল ও অবরোধ বন্ধে আইনি আশ্রয়ে যাবেন তারা।