Published in Sangram on Tuesday, 25 August 2015.
জিএসপি সুবিধা ও বাংলাদেশ
রহিমা আক্তার
বাংলাদেশের পোশাক খাত : মান নিশ্চিত করতে মুনাফা কি সম্পর্ক যুক্ত’ শীর্ষক সংলাপটিকে কেন্দ্র করে মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় সংলাপ। গত ১২ আগস্ট বুধবার সিপিডি ও ফ্রেডরিক এবার্ট স্টিফটুর (এফইএস) আয়োজিত এই সংলাপে জিএসপি সুবিধা পাওয়া বিষয়ে আলোচনা হয়। উক্ত আলোচনায় জিএসপি পাওয়া সম্পর্কে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেনÑ “জিএসপি সুবিধা পাওয়া দেশগুলোর অনেকের চেয়ে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি ভালো। যেসব দেশ জিএসপি সুবিধা পেয়েছে তাদের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ভালো। যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখাতে হবে যে কী কারণে বাংলাদেশকে দেয়া হয়নি। আমার মনে হচ্ছে এভাবে কোন তুলনামূলক পর্যালোচনা হয়নি। আশা করি বাংলাদেশের যেসব সমস্যা আছে সেগুলো নিজের শক্তি, ক্ষমতা ও দায়িত্বের মাধ্যমে পূরণ করা যাবে। তবে জিএসপি না পাওয়াটা আমার কাছে দুঃখজনক মনে হচ্ছে।”
অন্যদিকে একই দিনে অর্থাৎ গত ১২ আগস্ট বুধবার গাজীপুরের ইপিলিয়ন স্টাইল এবং উথা ফ্যাশন কারখানা পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে বার্নিকাট বলেন, “জিএসপি ফিরে পাওয়ার পর্যায়ে বাংলাদেশ এখনো পৌঁছেনি। তবে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক খাতের অনেক উন্নতি হয়েছে। এখনো যেসব কাজ বাকি আছে, সেগুলোও সঠিক পথে এগুচ্ছে।
তবে স্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়ন, স্বচ্ছ ডাটাবেইজের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। এদেশের শিল্প মালিক, বিদেশী ক্রেতা ও সাহায্য সংস্থা পোশাক খাতের সব দুর্বলতা সারিয়ে তুলতে একসাথে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে সহযোগিতা করছে। আশা করা যায়, সব শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ দ্রুতই জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে।”
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট আরো বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার পর্যায়ে বাংলাদেশ এখনো পৌঁছায়নি।” পাল্টাপাল্টি মতামত যাই হোক এটাই সত্যিই যে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের থেকে জিএসপি সুবিধা পেয়ে আসছিল। বাংলাদেশের প্রধান পণ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা পেত না।
পোশাক, চিংড়ির মতো পণ্যের বদলে যুক্তরাষ্ট্র সিরামিক, তামাক, গলফ খেলার উপকরণ, প্লাস্টিকসহ কয়েকটি পণ্যের জিএসপি সুবিধা দিয়ে রেখেছিল। ফলে ওইদেশে বাংলাদেশের প্রায় ৫৫০ কোটি রফতানি আয়ের এক শতাংশের কম আসতো জিএসপি সুবিধাভুক্ত পণ্য থেকে। বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করে ২০০৭ সালে ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতরে রিট পিটিশন দায়ের করেছিল দেশটির প্রভাবশালী শ্রমিক সংগঠন ‘দি আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার এন্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনস’ বার বার মামলার তারিখ পড়ে শুনানি হয়। মামলার পরবর্তী শুনানি দু’বছর করে মেয়াদ বাড়িয়ে বাংলাদেশের জিএসপি বহাল রাখা হলেও ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর সেই সুযোগ হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। অনেকের মতে, ২০১৩ সালের ২৭ জুন পোশাক ও চিংড়ি খাতে শ্রমের মান না রক্ষার কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিশ্বের ১২২টি দেশ ও অঞ্চলের জন্যে জিএসপি চালু করলেও বাংলাদেশকে এ সুবিধা না দেয়ার পেছনে রাজনীতি ছাড়া আর কোন কারণ নেই বলে জানালেন বর্তমান সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
গত ১১ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সাথে বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের শর্ত হিসেবে ১৬টি কর্মপরিকল্পনা দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে বলেছিল। আমার ধারণা, ওইসব শর্তের চেয়েও আমরা বেশি কিছু করেছি। এর পরও তারা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেনি। রাজনৈতিক কারণ ছাড়া জিএসপি ফিরে না পাওয়ার পেছনে আর কোন কারণ নেই। কেনিয়ার নাইরোবিতে গিয়ে বারাক ওবামা যেখানে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। সেখানে সামান্য জিএসপি সুবিধা না দেয়ার কোন কারণ নেই। তাই এ ব্যাপারে আমি আর কোন উদ্যোগ নিতে রাজি নই। আমরা তাদের দেয়া শর্ত পূরণ করেছি। জিএসপি না পেলে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না।”
বৈদেশিক মুদ্রার এক বিরাট অংশ আসে বাংলাদেশের পোশাক খাত থেকে। আর এই পোশাক খাতে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই জিএসপি সুবিধা দেয়নি। দেয়নি শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিক অসন্তোষ ও পোশাক খাতে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সমালোচনা করে যাচ্ছে। এই নিয়ে দেশের অভ্যন্তরেও সমালোচনার ঝড় উঠে মাঝে মাঝেই। আর এই মুহূর্তে আবার জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে আলোচনা -সমালোচনা আরো তীব্র আকার ধারণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের গড় শুল্কহার ১৫ শতাংশের বেশি। অথচ ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে এ শুল্কহার ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে।
২০১৩ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ জিএসপি স্কিম আবার সচল করেছে যুক্তরাষ্ট্র গত ২৯ জুলাই। ভারত পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানসহ অনেক দেশই এ সুযোগ পেয়ে থাকলেও এ থেকে বাদ পড়েছে রাশিয়া ও বাংলাদেশ। ২০১৩ সালের ২৭ জুন দেশটি বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে ১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ থেকে কার্যকর করে। বাংলাদেশে পুনরায় জিএসপি সুবিধা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনার কথা জানায়। এ দুই বছরে বাংলাদেশ সেসব শর্তগুলো পূরণ করার চেষ্টা চালায়।
কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে অযোগ্য দেশকে জিএসপি সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করায় ক্ষোভ এখন সবার।
জিএসপি সুবিধার আওতায় কোন দেশের পাঁচ হাজার রকমের পণ্য বিনা শুল্কে রফতানি করবে যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেই পণ্যের মাঝে বাংলাদেশর তৈরি পোশাক কখনোই ছিল না। দেশটির বাজারে বাংলাদেশের মোট রফতানি আয় ৫৫০ কোটির ৯০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে। বিশেষজ্ঞরা ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, জিএসপি স্থগিত হলেও বাংলাদেশের রফতানি আয়ে তেমন কোন প্রভাব পড়েনি, তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাব হবে মারাত্মক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যেখানে বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ১৬টি শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করেও জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেখানে রাজনীতির কলাকৌশল ছাড়া অন্য কোন কারণ থাকতে পারে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য যা করা প্রয়োজন বাংলাদেশ তা করছে, তবে এখনো সব শর্ত পূরণ না করায় তারা বাংলাদেশকে সুবিধা দিচ্ছে না। তাহলে আসল সমস্যাটা কোথায় তা এখনো জনগণের জানার বাইরে।
রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে উঠে আসে ২০০৮ সালের আগে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সম্পর্ক থাকলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সরকার গঠনের পরই ওয়াশিংটনের সাথে ঢাকার দূরত্ব বাড়তে থাকে। ওইসময় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ও পরে ড্যান ডাব্লিউ মজীনা নানা ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার ফলে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা হারায়। বর্তমান সরকারের প্রথম দফার মেয়াদ শেষ হলেই নির্বাচনের অনেক অংশ ঘিরে আলোচনায় আসেন মজীনা। মজীনা প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করেন। আর সেই কারণেই রাজনীতির সাথে জিএসপি সুবিধা পাওয়াকে এক করছেন বর্তমান সরকার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রফতানি করছে। অথচ ভারতের ক্ষেত্রে গড় শুল্কহার ২ দশমিক ২৯ শতাংশ। চীনের ক্ষেত্রে ৩ দশমিক ৮, তুরস্কের ক্ষেত্রে তা ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এই শুল্কহার সমান হলে বাংলাদেশ আরো বিপুল পরিমাণ পোশাক রফতানি করতে পারতো। বাংলাদেশ বিশ্বের তৈরি পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতের পরে। কেন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করছেন। তা ঠিকভাবে পরিস্কার না হবার কারণেই বিষয়টিকে রাজনীতির কারণ হিসাবে দাঁড় করানো হচ্ছে। রাজনীতির কোন অদেখা কারণ থাকলেও এটাই সত্য যে বাংলাদেশের শ্রম মানের অবস্থা এখনো ভালো না। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, বোনাস থেকে শুরু করে পরিবেশ ঠিকভাবে গড়ে উঠছে না। হাতেগোনা কয়েকটি কারখানার পরিবেশ দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলা যায় না। বড় কোন ক্ষতির আগে এ বিষয়ে সরকারকেই এগিয়ে এসে কাজ করতে হবে।