Published in Manobkantha on Tuesday, 8 April 2014.
বিনিয়োগ ঘাটতিতে দেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বড় ধরনের বিনিয়োগ ঘাটতির মধ্যে আছে দেশ। বছরের পর বছর ধরে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। গত কয়েক বছরে সরকারি বিনিয়োগ সামান্য বাড়লেও বেসরকারি বা ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংক ঋণের উচ্চসুদ ও রাজনৈতিক কারণে এখন নিু বিনিয়োগ ফাঁদে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। তাদের মতে, বিনিয়োগ বাড়িয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন বর্তমান সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদ অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে বিনিয়োগ ক্রমই কমছে। অথচ সরকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ২০১০ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২০১৫ অর্থবছরে ৮ শতাংশ উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। পরিকল্পনায় বলা হয়, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮-১০ শতাংশ অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে বিনিয়োগের হার দ্রুত বাড়াতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হয় তবে বিনিয়োগের হার ৩২ শতাংশ করতে হবে।’ কিন্তু পরিকল্পনার বিপরীতে বিনিয়োগের প্রকৃত চিত্র খুবই হতাশাজনক। পরিকল্পনায় প্রাক্কলিত বিনিয়োগর তুলনায় প্রকৃত বিনিয়োগ কমছেই। বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছরটি ছিল পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তৃতীয় বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, তৃতীয় বছরে বিনিয়োগের হার হয়েছে ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিগত বছরে বিনিয়োগ হওয়ার কথা ছিল ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ। আর আগামী ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিনিয়োগ হার যথাক্রমে ৩১ ও ৩২ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। আর পরিকল্পনার প্রথম ও দ্বিতীয় বছরেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিনিয়োগ হয়নি।
তথ্যে দেখা যায়, সবচেয়ে দুরবস্থা বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। ২০০৯ সালে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বিগত ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের হার এটাই সর্বনিু। তবে সরকারি বিনিয়োগ ২০০৯ সালে জিডিপির ৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ায় আকাক্সক্ষায় এই বিনিয়োগ ঘাটতিই একমাত্র বাধা। আর বিনিয়োগ ঘাটতির অন্যতম কারণ বিনিয়োগ চাহিদা পূরণে বেসরকারি তথা ব্যক্তি খাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে না পারা।
সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ‘এই সরকার যে তার প্রাক্কলন অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারল না, তার সবচেয়ে বড় কারণ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকে সচল করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এটার প্রথম দিকের বড় কারণ ছিল বিদ্যুৎ ও গ্যাস না পাওয়া। পরবর্তী সময়ে কারণ হয়েছে ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের অব্যবস্থাপনা। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যে সংস্কার দরকার ছিল, তা করতে না পারা।’
বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানিসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত সংকটের কারণে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না বিনিয়োগকারীরা। এখন আবার রাজনৈতিক কারণে ধীরে চলো নীতি বজায় রাখছেন তারা। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণও নিচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমানতের তুলনায় ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। রাষ্ট্রীয়, বেসরকারি এবং বিদেশি খাতের ১৯টি ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। এখন ঋণ ও আমানতের গড় অনুপাত (এডিআর) দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের ৮৫ শতাংশ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে হয়।
এ প্রসঙ্গে এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল আমিন বলেন, ‘নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দেশের পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছেন না। ফলে এ নির্বাচনকে ঘিরে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা আসতে পারে এ কারণে ব্যবসায়ীরা এখনো পুরোপুরি বিনিয়োগে উৎসাহী হচ্ছে না। ফলে এখনো ব্যাংকের ঋণ বিতরণ নেতিবাচক ধারায় চলছে।’
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, ‘বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। বিনিয়োগের জন্য দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামোগত সুবিধা এবং মানুষের চাহিদা। বর্তমানে অবকাঠামো সুবিধা কিছুটা থাকলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তাই তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। ব্যবসায়ীদের জন্য বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
ডিসিসিআই সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম বলেন, ‘বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকমুখী হচ্ছেন না। এ কারণেই কমছে দেশীয় বিনিয়োগ। দেশীয় বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারকে অবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য আগামী বাজেটে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ভর্তুকিমূলক ব্যবস্থা চালুর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদহার কমাতে হবে।