এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশের অর্থপাচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনটি বলছে, জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ২ ভাগ পাচার হয়ে যাচ্ছে।
Published in Inquilab on Tuesday, 13 October 2015.
বিদেশে অর্থপাচার ঠেকাতে হবে
একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ব্যাংক লোপাটের অভিনব পদ্ধতি এখন এলসি বাণিজ্য। ভুয়া কোম্পানী খুলে ভুয়া এলসির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে শতশত কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে একাধিক চক্র। সরাসরি ব্যাংক ঋণ না নিয়ে এলসি খোলার মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে চক্রটি। ব্যাক টু ব্যাক, মেশিনারিজ আমদানির এলসি অ্যাকাউন্ট খুলে এই জালিয়াতি করছে তারা। পণ্য আমদানি না করে কাগজ দেখিয়ে বিদেশি ব্যাংকের কাছে বিল পরিশোধ করে স্থানীয় ব্যাংক। তদারকির অভাবে এলসি জালিয়াতি থামছে না ব্যাংকগুলোতে।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশের অর্থপাচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনটি বলছে, জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ২ ভাগ পাচার হয়ে যাচ্ছে।
পাচার করা অর্থরোধে কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে সক্ষম না হলেও রাজনৈতিক ফায়দা লাভে আন্তর্জাতিক অর্থপাচার বিশেষজ্ঞ দলের সাথে মতবিনিময়কালে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের সাফল্যের চিত্র হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর কথিত পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার তথ্য তুলে ধরেছে। অর্থের পাচার ঠেকিয়ে কিভাবে তা জাতীয় অর্থনীতিতে কাজে লাগান যায়, এ পদক্ষেপ গ্রহণ করাই বাস্তবানুগ।বিদেশে অর্থপাচার অনেকটা মহামারি আকার ধারণ করেছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে শুধুমাত্র সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতেই বাংলাদেশিরা জমা করেছে, ৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা পাচারে জন্য একের পর এক নতুন নতুন কৌশল তৈরি করছে অসাধু চক্র। অবৈধ পথে টাকা নেয়ার পাশাপাশি বাণিজ্যের আড়ালেও পাচার হয়ে যাচ্ছে টাকা। প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশ থেকে যাচ্ছে দেশের বাইরে। বলা হচ্ছে, ব্যাংক বীমা ও অর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মানিচেঞ্জার ও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারে প্রধান খাত হিসেবে আমদানি ব্যয় বেশি ও রফতানি আয় কম দেখানোকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সমন্বয়হীনতাকে পাচারের জন্য দায়ী করেছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এবং বিনিয়োগের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকাতেই অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে গত পাঁচ বছরে সরকারি-বেসরকারি ১১২টি ব্যাংকের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব দুর্নীতর সাথে অধিকাংশ ব্যাংকের কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। রাষ্ট্রায়াত্ত সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা ও কৃষি ব্যাংকে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংকের পরিচালকদের অনেকেই এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছেন। ব্যাংকের এলসি জালিয়াতি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, এই ধরনের জালিয়াতি থামাতে না পারা দুর্ভাগ্যজনক। তিনি এর সাথে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, জড়িতদের কঠোরভাবে শাস্তি না দিলে এটা থামানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকজন সাবেক ডেপুটি গভর্নর মনে করেন, এটা ঠেকাবার একমাত্র উপায় হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি ও পরিদর্শন। রাজনৈতিকভাবে পর্ষদ নিয়োগ দিলে এগুলো বন্ধ করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অথবা যেকোনভাবেই হোক অবৈধ অর্থের বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করা না গেলে অর্থপাচার রোধ করার কোন উপায় নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কালো টাকা সাদা করার কার্যকর ব্যবস্থা থাকলেও দেশে এ ধরনের ফলপ্রসূ কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং এক ধরনের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কালো টাকা পাচার বিষয়টি ব্যবহার করা হচ্ছে। আরাফাত রহমান কোকোর টাকার নিয়ে যে রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের চেষ্টা হয়েছে তা যদি প্রকৃতই পাচার রোধের লক্ষ্যে কোন ব্যবস্থা হতো তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে কিভাবে? অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে যেসব পাচারকৃত অর্থ রয়েছে সেগুলো উদ্ধারে কোন ব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না? সাবেক একজন ডেপুটি গভর্নর যথার্থই ইঙ্গিত দিয়েছেন, এধরনের পাচারের সাথে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে।এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ গভর্নর নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এটা অত্যন্ত খুশির খবর। মুদ্রা পাচাররোধের বিষয়টি প্রধানত দেখভাল করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বলা হচ্ছে, কেবলমাত্র তদারকির অভাবেই এলসি জালিয়াতি থামানো যাচ্ছে না। এর অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা প্রশ্ন সাপেক্ষ হয়ে উঠেছে। সরকারে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে যদি অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে, তাহলে এর দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরেরও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগে যে খরা দেখা দিয়েছে তার সাথে পাচার যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলবে অর্থপাচার রোধ এবং কালোটাকা যাতে দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হতে পারে, এ অর্থ যাতে দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় সেদিকে নজর দেয়া জরুরি হয়ে উঠেছে। অর্থনীতি শক্তিশালীকরণে সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হবেন, এটাই প্রত্যাশিত।