Published in Jugantor on Sunday, 2 February 2014.
রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতি ৪৯ হাজার কোটি টাকা
মনির হোসেন
দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় গত ৬ মাসে ক্ষতি হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকার। এই ক্ষতি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পরিবহন রেলওয়ে সেক্টরে। এরপরেই রয়েছে কৃষিভিত্তিক শিল্প, পোশাক ও বস্ত্র এবং পর্যটন খাতে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের পর্যালোচনায় এ তথ্য তুলে ধরেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য স্ক্যান করে আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে তা সমন্বয় করেছে। পরে তারা এর আর্থিক মান মূল্যায়নে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মতে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক এবং আস্থাভাজন নির্বাচন ছাড়া নতুন বিনিয়োগ আসবে না। এ কারণে আগামী দিনে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি কমতে পারে।
পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৮০ দিনের মধ্যে দেশে ৫৫ দিন হরতাল-অবরোধ হয়েছে। ফলে এ সময়ে দেশের উল্লেখযোগ্য চার খাতে ক্ষতি হয়েছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। এরমধ্যে রেল, সড়ক পরিবহন এবং নৌপরিবহন খাত মিলিয়ে ক্ষতি ১৬ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কৃষিভিত্তিক শিল্প। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। এই শিল্পের মধ্যে সবজি, কৃষিযন্ত্র, পোলট্রি, হিমায়িত খাদ্য এবং পাট রয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা গার্মেন্ট ও বস্ত্র খাতে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি এবং পর্যটন খাতে ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও হরতাল-অবরোধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হয়েছে। উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
সংস্থাটি আরও বলছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে উৎপাদন বন্ধ থাকায় প্রবৃদ্ধি কমবে। মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও বছর শেষে তা ৫ দশমিক ৬ থেকে ৫ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি হবে না। এক্ষেত্রে গত কয়েক বছর থেকে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল, তা অব্যাহত রাখা যাবে না। সিপিডি আরও বলছে, প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগ। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে বিনিয়োগ হয় না। সংস্থাটির মতে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আপতত দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। এর ফলে যেসব প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ হয়েছিল, ওইসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন শুরু হতে পারে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া নতুন বিনিয়োগ আসবে না। ফলে প্রবৃদ্ধিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে না। এরমধ্যে বিশ্বব্যাংক বলছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭ থেকে ৬ দশমিক ০ শতাংশের মধ্যে থাকবে।
সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক এবং আস্থাভাজন নির্বাচন ছাড়া নতুন বিনিয়োগ আসবে না। এ কারণে আগামী দিনে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত কয়েক মাসে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু সমস্যা ছিল। রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে গেছে- যা বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে সংস্থাটি আরও বলছে, ব্যাংকিং খাতে বড় বড় স্ক্যান্ডালের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ৮৬ হাজার কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য জমা হয়ে আছে। এর ফলে সরকারের ঋণ নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অভ্যন্তরীণ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৮ এবং বেসরকারি খাতে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। এর অর্থ হল কেউ টাকা নিচ্ছে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বাজেটে মোট ঘাটতির ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সংগ্রহের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বিদেশী সাহায্য কম আসায় এ পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে।
গত ৬ মাসে দেশ থেকে জনশক্তি রফতানি কমেছে। এছাড়া যারা আছে, তারাও কম টাকা পাঠিয়েছে। ৬ মাসে জনশক্তি রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এ সময়ে রেমিট্যান্স আয় কমেছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।