বাংলাদেশসহ অন্য উদীয়মান ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বড় চিন্তার কারণ বলেই মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। আমরা চীনের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধির আশা করছি। দেশটি থেকে অনেক কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তর করা হবে বলেও প্রত্যাশা রয়েছে। সিপিডি মনে করছে, চীনের অর্থনীতি স্থবিরতা থেকে বেরোতে না পারলে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। বার্তাটি আমরা যত দ্রুত অনুধাবন করতে পারব ততই মঙ্গল।
Published in Bonik Barta on Friday, 6 November 2015.
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
বৈশ্বিক সক্ষমতা উন্নয়নে যা করা দরকার
ড. আনু মাহ্মুদ
অর্থনৈতিক ফোরামের রিপোর্ট অনুসারে ১৪০টি দেশের মধ্যে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭তম। ২০১৩ সালে আমাদের এ অবস্থান ছিল ১০৯তম স্থানে। দুই ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং বাজারের আয়তনের লক্ষণীয় উন্নতি। প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট ১৬টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, জরিপে মতামত দেয়া ৫৬ ব্যবসায়ীর মধ্যে ৯৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিক অবস্থান দুর্বল। তাদের মতে, জনগণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার কঠোরভাবে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশের সমস্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অবকাঠামো। তৃতীয় সমস্যা হলো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এছাড়া পর্যায়ক্রমে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। পুঁজির সহজলভ্যতা নেই। ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় জমা হলেও এখনো সুদের হার তেমন কমেনি। সহজে ঋণও পাওয়া যায় না। সংস্থাটির বিবেচনায় অন্য সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে— নীতিনির্ধারণে অস্থিতিশীলতা, প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাব, উচ্চ কর হার, করের বিভিন্ন আইনে জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রার নীতি, মূল্যস্ফীতি, নৈতিকতার অভাব, উদ্ভাবনী ক্ষমতার অভাব, শ্রম আইনের সীমাবদ্ধতা এবং জনস্বাস্থ্য।
জরিপে মোট ৭ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৩ দশমিক ৭৬। তবে অর্থনৈতিক সক্ষমতায় আমরা দুই ধাপ এগোলেও এই একই জরিপ থেকে জানা যায়, অবকাঠামো, আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, শ্রমবাজারের দক্ষতা, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির দিক থেকে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি। কৃষি ও শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ অনেক আগেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ কাটিয়ে উঠেছে। নিজেদের সক্ষমতার প্রশ্নে আমরা যে এগিয়েছি অনেকটা পথ, তা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনই বলে দেয় স্পষ্ট করে। তবে এখানেই থেমে যাওয়ার সুযোগ নেই, সুযোগ নেই আত্মতৃপ্তিরও।
বিশ্বজুড়েই আজ প্রতিযোগিতা। প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক মানদণ্ডের পরিবর্তন ঘটছে। খাদ্য উত্পাদনসহ অনেক ক্ষেত্রে এরই মধ্যে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি বটে, তবে তা যথেষ্ট নয়। এখনো অনেক ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি, যা শুধু বৈশ্বিক মানদণ্ডেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মানদণ্ডেও। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে যেসব বাধা রয়েছে, এখনই তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। সীমিত সম্পদ এবং প্রচুর সীমাবদ্ধতার পরও আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ যেন নিজেদের ভুলে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সচেতন হতে হবে। আর এক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দুর্নীতির মূলোত্পাটন।
সার্বিক বিচারে সূচক খানিকটা উন্নীত হলেও আপেক্ষিক বিচারে তা হতাশাব্যঞ্জক। ১৬ সমস্যার আলোকে সূচকটি নির্ধারিত হয়। এর প্রথম ছয়টিতে কোনোই পরিবর্তন আসেনি। এগুলো হচ্ছে— অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, দুর্নীতি, অক্ষম আমলাতন্ত্র, সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে সংশয়, ঋণপ্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধতা ও সরকারি নীতির সমন্বয়হীনতা। শিক্ষিত শ্রমশক্তির অভাব, মূল্যস্ফীতি, অপরাধ ও চুরি এবং দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা— চারটি সমস্যার মাত্রা আগের তুলনায় কমলেও পরিবর্তনটি সামান্য।
বাংলাদেশসহ অন্য উদীয়মান ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বড় চিন্তার কারণ বলেই মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। আমরা চীনের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধির আশা করছি। দেশটি থেকে অনেক কারখানা বাংলাদেশে স্থানান্তর করা হবে বলেও প্রত্যাশা রয়েছে। সিপিডি মনে করছে, চীনের অর্থনীতি স্থবিরতা থেকে বেরোতে না পারলে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। বার্তাটি আমরা যত দ্রুত অনুধাবন করতে পারব ততই মঙ্গল।
কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। এখন আমরা মধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়ার লড়াইয়ে রয়েছি। এছাড়া জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে সফল হওয়ার পর বাংলাদেশ এবার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে। এমন সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ নিয়ে নেতিবাচক কোনো সংবাদই কাম্য হতে পারে না।
ভারত এক লাফে ১৬ ধাপ এগোতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারে না? আমাদের অগ্রগতির পথে বাধাগুলো তো চিহ্নিত! তাহলে কেন সেগুলো গুঁড়িয়ে দিতে পারি না! কেন প্রতিবন্ধকতার সামনে বারবার অসহায় আত্মসমর্পণ! সাফল্যের পথে প্রতিবেশীরা এগিয়ে যাবে, আমরা পিছিয়ে থাকব— এটা গ্লানিকর। বাধাগুলো রাতারাতি দূর করা সম্ভব না। কিন্তু অপসারণ অভিযান তো শুরু করতে হবে! প্রশাসনে দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রে অদক্ষতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা— এসব নতুন নয়। তার পরও পরিবর্তনের পথে আমাদের অভিযাত্রা শুরু না হওয়া বেদনাদায়ক।
১০ প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় ভালো করার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে, অবকাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সামষ্টিক অর্থনীতিতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। যদিও এটা ইতিবাচক, তবু মনে রাখতে হবে— দক্ষতা উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে। আর যদি এসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন নিশ্চিত হতো, তবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বাংলাদেশ আরো ভালো অবস্থানে থাকত। এ পরিস্থিতি অনুধাবন করে অগ্রগতির ধারা আরো বেগবান করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
এবার বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় অগ্রগতি সম্পর্কে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, সূচকে স্কোর বাড়লেও তুলনামূলক অবস্থানে প্রায় একই। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে স্বাভাবিকভাবেই অগ্রগতির ধারা আরো গতিশীল করতে হবে, আর তার জন্য উদ্ভাবনী শক্তির ওপর ভিত্তি করে দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
আমরা বলতে চাই, অগ্রগতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এগিয়ে গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও পণ্যবাজারের সক্ষমতা বিবেচনায় বাংলাদেশ পিছিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এসব ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে নজরদারি বাড়াতে হবে। যদি সমস্যাগুলো আমলে নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তবে সমাধান কঠিন কিছু নয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় শক্তি এর বাজার। বাজারের আকারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম। সামষ্টিক অর্থনীতিতে অবস্থান ৪৯তম। বড় বাজারের শক্তিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা গেলে তা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত দিতে পারে। ব্যবসায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বাংলাদেশ এগোলেও সেই অগ্রগতির গতি বৃদ্ধি করা দরকার। আমরা যখন দুই ধাপ এগিয়েছি, ভারত তখন এগিয়েছে ১৬ ধাপ, ভিয়েতনাম ১২ ধাপ। যে সূচকগুলোয় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো নয়, সেগুলোয় অবস্থান ভালো করার জন্য পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। জ্বালানি সংকট এবং দেশ থেকে পুঁজি পাচার হয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটিতে। প্রতিবেদনটিতে আরো কিছু সমস্যার উল্লেখ করা হয়েছে— ব্যাংকে সুদের উচ্চহারসহ অন্যান্য কারণে ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কঠিন, রফতানিতে মূল সমস্যাগুলো অপরিবর্তিত, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্যের অভাব, সীমান্তে দুর্নীতি এবং অভ্যন্তরীণ পরিবহন বিলম্বের কারণে ব্যয় বৃদ্ধি। এসব সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়নি। ব্যবসায়ী প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় দেশের অবস্থানের উন্নয়নকে সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। তাহলে সামনের দিনে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ধাপ অগ্রসর হবে— এটা নিশ্চিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক