Published in Jugantor on Wednesday, 30 April 2014.
স্বদেশ ভাবনা
আন্দোলনের আগেই সমাধান হোক
আবদুল লতিফ মন্ডল
‘আন্দোলনের আগেই মধ্যবর্তী নির্বাচন’ শিরোনামে ২৮ এপ্রিল যুগান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মেয়াদ নিয়ে মন্ত্রী-এমপিরা যাই বলুন, আগামী দেড় থেকে দু’বছরের মাথায় নির্বাচন দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। তবে এ নির্বাচনের আগে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা হবে। এতে ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা’ নির্ধারণ করা হতে পারে। সরকারের এক নীতিনির্ধারক সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর হাতে নতুন একটি প্রস্তাবনা তুলে দিয়েছেন। এ প্রস্তাবনায় আগাম নির্বাচনের ইঙ্গিত রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে সাংবিধানিক ও আইনগত বাধা না থাকলেও একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসে স্বস্তিতে নেই সরকার। আগামী এক-দেড় বছর পর থেকে বিএনপি কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। সম্ভাব্য ওই আন্দোলন, একতরফা নির্বাচনের দুর্নাম ঘোচানো এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপের কারণে আগাম নির্বাচনের কথা সরকারের শীর্ষ মহলে আলোচনা করা হচ্ছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্জিত দশম সংসদ নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক হয়নি এবং এতে জনগণের আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন ঘটেনি সেটা উপলব্ধি করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে একাদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি সমাধানের ওপর জোর দেন এবং সেজন্য বিএনপিকে ধৈর্য ধারণ করতে, সহনশীল হতে এবং সব ধরনের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপের বিষয়ে ইতিবাচক বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিএনপি আলোচনার স্বার্থে এ যাবৎ কঠোর কর্মসূচি পালনে বিরত রয়েছে এবং একাধিকবার সংলাপ শুরু ও সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছে। সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, তারা কেউ কারও শত্র“ নন। অতীতে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব হলে এখন হবে না কেন?
এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, ভোটারবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একতরফা দশম সংসদ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচিত হয়েছে। ৬ জানুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছার আহ্বান জানান। এ ছাড়া দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে পুনরায় সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানায় আরও কয়েকটি দল ও সংগঠন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) ও নাগরিক সমাজ।
দেশের বিশিষ্টজনদের অনেকে এ নির্বাচনকে তামাশার নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং নির্বাচন বাতিলের দাবি জানান। কেউ কেউ বলেন, এ নির্বাচন অবৈধ না হলেও এর নৈতিক সমর্থন নেই। আবার অনেকে শংকা প্রকাশ করে বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা আগের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে।
দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং জনগণের আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় নির্বাচনের পর পরই হতাশা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মহল। সীমিত অংশগ্রহণ ও কম ভোটার উপস্থিতির কারণে হতাশা ব্যক্ত করে কমনওয়েলথ। দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এ নির্বাচনে মানুষের আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন ঘটেনি। তবে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর এখন রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দ্রুত সংলাপ শুরুর তাগিদ দেয় দেশটি। নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ভবিষ্যতে ভয়ভীতি ছাড়া সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দেয় যুক্তরাজ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নও নির্বাচনের ফলাফলে হতাশা প্রকাশ করে। একমাত্র ভারত ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন সমর্থন করে এবং বলে, বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার স্বার্থে এ নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। তবে একই সঙ্গে দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে আরও একটি সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিতে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দেয় ভারত। পশ্চিমা বিশ্ব সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার কথা বললেও তারা একই সঙ্গে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপিসহ সব দলের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে অর্থবহ আলোচনা শুরুর তাগিদ দেয় সরকারকে। এ চাপ অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল বোস্টনে এক সেমিনারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য চাপ অব্যাহত রাখবে। এটা না করা হলে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মধ্যবর্তী তথা একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রয়োজন কেন?
এক. গত প্রায় ২০ বছর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনগুলো জনগণের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করাসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে যে পরিমাণ দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে, দশম সংসদ নির্বাচন ঠিক সে পরিমাণ সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম দু’দশকে অর্থাৎ সত্তর ও আশির দশকে জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে, নির্বাচন কমিশন নয়, সরকারই জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো মানুষের মন থেকে সে ধারণা দূর করতে সক্ষম হয়। দশম সংসদ নির্বাচনে এ ধারণার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে হারানো সুনাম ফিরে পাওয়া যেতে পারে।
দুই. দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটবে না বলে মনে করছেন অনেকে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা চলছে। সম্পদের সহজলভ্যতা, রাজস্ব আয়, বৈদেশিক অনুদান ও বিনিয়োগ সবকিছুই কমছে। এজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দায়ী। সংস্থাটির মতে, একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ছাড়া নতুন বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না।
তিন. সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল একদিকে যেমন সরকারের প্রস্তাবের সমালোচনা করে, তেমনি অন্যদিকে ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে। জাতীয় পার্টি দশম সংসদ নির্বাচনে যোগ দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির ফর্মুলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বি^তায় বা নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বি^তায় ৩৪টি আসনে জয়লাভ করে একদিকে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং অন্যদিকে তিনজন সংসদ সদস্য মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ হয়েছেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। বিরোধী দলের সদস্যদের মন্ত্রিসভায় যোগদানের নজির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কেউ কেউ একে গণতন্ত্রের পেছনে ছুরিকাঘাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একে ‘বিরোধী দলবিহীন সংসদ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তাই একটি গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল।
একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় এবং তা হল, ‘আলোচনার মাধ্যমে একাদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি সমাধান করা হবে’- প্রধানমন্ত্রী ৬ জানুয়ারি এরূপ বক্তব্য দেয়ার পর আজ পর্যন্ত নতুন নির্বাচন নিয়ে কোনো বক্তব্য রাখেননি। নতুন তথা একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে তিনি যে গভীরভাবে ভাবছেন এটাই তা বলে দেয়।
মধ্যবর্তী তথা একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে দুটি ইস্যু বড় হয়ে দেখা দেবে। ইস্যু দুটির একটি হল, কোন ধরনের সরকার ব্যবস্থার অধীনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? বিএনপি চাইবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। বিএনপি নেতৃবৃন্দ ইতিমধ্যে বিভিন্ন ফোরামে এরকম বক্তব্য রেখেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ চাইবে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন। দ্বিতীয় ইস্যুটি হল, নির্বাচন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে, নাকি পুনর্গঠিত ইসির অধীনে অনুষ্ঠিত হবে? এক্ষেত্রে বিএনপি চাইবে পুনর্গঠিত ইসির অধীনে নির্বাচন। আর আওয়ামী লীগ চাইবে বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচন। আলোচনার মাধ্যমেই এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে হবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে খোলা মন নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে এবং আলোচনার টেবিলেই সমাধান পেতে হবে। আলোচনা ছাড়া চলমান সমস্যা সমাধানের কোনো বিকল্প উপায় নেই। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ওপর জাতীয় স্বার্থকে স্থান দিতে পারলেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে দেরি হবে না।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com