Published in Arthoniti Protidin on Friday, 7 February 2014.
জিডিপি নির্ধারণ নিয়ে বিপাকে অর্থমন্ত্রণালয়
বাজেটের অর্থায়নে দাতাদের সঙ্গে বৈঠকের তাগিদ
অর্থনীতি প্রতিবেদক
চলতি (২০১৩-১৪) অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ঠিক করতে হিমশিম খাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। উচ্চপর্যায়ের দুটি সভা করেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ছাড়া সংশোধিত বাজেটের অন্যান্য আকার নিয়েও কর্মকর্তাদের রয়েছে নানা মত।
জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় সভা করে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, অর্থবছরের বাকি সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য নতুন করে পরিকল্পনা নিতে বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানটিকে আরো যতœবান হতে বলা হয়েছে। কেননা গত মাসে মূল্যস্ফীতিতে ঊর্ধ্বমুখী ভাব দেখা দিয়েছে, যা অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে বলে মনে করেন খোদ অর্থমন্ত্রী। বাজেটের অর্থায়ন স্বাভাবিক রাখতে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে দ্রুত বৈঠকের ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৈঠক সূত্র আরো জানায়, রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার কারণগুলো আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইস্টার্ন রিফাইনারি, বাংলাদেশ পুলিশ, নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান ডেফার্ড পেমেন্টের ভিত্তিতে পণ্য চালান খালাস করায় তাদের কাছে শুল্ক কর বকেয়া রয়ে গেছে। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন কাস্টমস স্টেশন থেকে শুল্ক কর কম আদায়, ডলারের সঙ্গে বাংলাদেশের মুদ্রার বিনিময় হারে কিছুটা তারতম্য প্রভৃতি। তবে আমদানিপর্যায়ে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের মতে, অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। ফলে এ সময় প্রথম ছয় মাসের তুলনায় বেশি রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। পাশাপাশি রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের মামলাগুলোর বিশেষ ব্যবস্থায় নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৯৬১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৭০২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি অর্জিত হবে না বলে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ইতোমধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছে। দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি হবে না বলে উল্লেখ করে সম্প্রতি বলেছে, রাজস্ব খাতে বড় ধরনের ঘাটতির কারণে এবার উন্নয়ন ও রাজস্ব বাজেট কাটছাঁট করতে হবে। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো গেলেও ব্যয়সংকোচন ছাড়া অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ সংযত রাখা সম্ভব হবে না।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে রাজস্ব ঘাটতি ও উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ায় চলতি বাজেটে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হতে পারে। বাজেট ঘোষণার সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অর্থবছরের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির গতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এনবিআরের আয় কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক সাহায্যে ভাটা পড়ায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সম্পদের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধার মুখে পড়েছে।’
সূত্রমতে, বাজেটের আকার প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা কমানো হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের মোট আকার হচ্ছে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এটা কমিয়ে দুই লাখ চার হাজার কোটি টাকা করা হতে পারে। এর মধ্যে উন্নয়ন বাজেট (এডিপি) থেকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করা হতে পারে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি সাত শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বাজেট ঘাটতি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে।
জানা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৭ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৪৯ হাজার নয় কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ আট হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ হাজার কোটি টাকা কমানোর পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।
গতকাল বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে অনেক ডিফারেন্ট ওপিনিয়ন আছে।’
বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে Ñ জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মিটিংয়ে আমরা রিভিউ করেছি। এটা এখনো শেষ হয়নি।’
জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কত হতে পারে Ñ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তো এ বিষয়ে অনেকদিন আগে থেকেই বলছি। এর চেয়ে কম প্রত্যাশা করি না।’
জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা কি ৬ দশমিক ৩-ই থাকবে Ñ এর জবাবে মুহিত বলেন, ‘সেটা বলতে পারব না, এখনো ঠিক করিনি। অনেক ভিন্ন মত (ডিফারেন্ট ওপিনিয়ন) আছে, আবার বসতে হবে।’ অবরোধ-হরতালের প্রভাব কি ভয়াবহ Ñ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নো’।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রসঙ্গে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর পূর্বাভাসের পর অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘সাধারণত নির্বাচনের বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় দুই থেকে তিন শতাংশ কমে যায়। এর পরও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশের কম হবে না বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।’