CPD study on political business cycle, economic implication of hartal cited

Published in Kaler Kantho on Tuesday, 24 December 2013.

ভোটের অধিকারের নামে ভাতের অধিকার হরণ

রাজীব আহমেদ

এত কিছুর পরও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আশ্বিন-কার্তিকের খরায় এ দেশের ঘরে ঘরে যে অভাব লেগে থাকত, তা এখন আর নেই। একসময়ের দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলে এখন ‘মঙ্গা’ প্রায় ভুলে যাওয়া একটি শব্দ। দেশে অভাবী মানুষ এখনো আছে, কিন্তু তাদের ঘরে এক বেলা হলেও রান্না হয়। তাদের সন্তানরা শিশুকালে নূ্যনতম শিক্ষাটুকুর সুযোগ পায়। রোগ-শোক হলেও তা মহামারি রূপ নিতে পারে না। আঁতুড়ঘরেই মাকে কাঁদিয়ে শেষ চিৎকার দিয়ে চিরবিদায় নেওয়া নবজাতক এখনো আসে; কিন্তু তারা সংখ্যায় কমেছে। এতসব অর্জন এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের। রাজনীতিকরা ছিলেন পথ দেখানোর দায়িত্বে। তাঁরা চার দশকে সঠিক পথ দেখাতে পারলে দেশ হয়তো আরো এগিয়ে যেত। কিন্তু তাঁরা আমাদের কোন পথ দেখাচ্ছেন? রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আজকের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখেছেন রাজীব আহমেদ- 

kaler-kantha

অবরোধের কারণে যে কৃষক তাঁর পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না, তিনি একজন ভোটার। শহরের যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর আয় অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান তাকেও দিয়েছে নেতৃত্ব পছন্দের অধিকার। যে কম্পানির পণ্য গুদামে থাকতে থাকতে নষ্ট হচ্ছে, সেই কম্পানির মালিক ও কর্মচারীরাও বাংলাদেশেরই নাগরিক। বছরের একটি দিন তাঁরা পছন্দের দলকে ভোট দিয়ে পাঁচ বছর ভালো থাকার আশায় থাকেন। কিন্তু তাঁদের জীবন-জীবিকার পথ আটকানোর যে রাজনৈতিক কর্মসূচির ধারা বাংলাদেশে চলছে ও অতীতে চলেছে, তা থেকে নিষ্কৃতি চায় সেই ভোটাররাই, বাংলাদেশের নাগরিকরাই এবং তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

১৯৯১ সালে এ দেশে গণতান্ত্রিক আমল শুরুর পর আশা ছিল অস্থিরতার অবসান হবে। কিন্তু তা হয়নি। পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা আর ক্ষমতা থেকে নামানোর চেষ্টায় ব্যস্ত রাজনীতিকদের কারণে এ দেশের মানুষের ভাগ্য বৃত্তবন্দি হয়ে যাচ্ছে। ১৬ কোটি মানুষকে নিয়ে যে ট্রেন অগ্রগতির পথে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলার কথা তার লাইনের ফিশপ্লেট খুলে যাচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় যে স্বাধীনতার চার দশক পরও বাংলাদেশে অহরহ হরতাল-অবরোধ হয় এবং মানুষ তাতে আশ্চর্য হয় না। একজন নেত্রী মানুষের ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেন না, অন্যজন সেই ভোটের অধিকার রক্ষার জন্যই পেটের অধিকার হরণ করছেন।

হরতাল-অবরোধ করে সরকারের টিকিও ছোঁয়া যাচ্ছে না। সরকারের মন্ত্রীরা, আওয়ামী লীগের নেতারা গাড়ি নিয়ে ঠিকই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পুড়িয়ে মারা হচ্ছে আসাদ-গাজীদের, যাঁদের আয় ছাড়া পরিবারের আর কোনো সম্বল নেই। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একজন ব্যবসায়ীর পণ্যের ট্রাক, যার সঙ্গে পুড়ে যাচ্ছে তাঁর পুঁজি। রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানরা বিদেশে পড়াশোনা করছেন। অর্থের অভাব না থাকায় তাঁদের আধপেটা খেয়ে থাকতে হচ্ছে না। দুর্গতি হচ্ছে তাঁদের, যাঁরা পাঁচ বছরে একদিন নিজের ভোট দিয়ে বাকি চার বছর ৩৬৪ দিন নিজেদের পেটপূজা করেন। একদিনের ভোটের অধিকারের চেয়ে বাকি দিনগুলোর ভাতের অধিকার তাঁদের জন্য অনেক বড়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে রাজনৈতিক নেতাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। তাঁদের নেতা-কর্মীরাও কিছু কিছু ভাগ পান। কিন্তু শ্রমজীবীদের দিন চলে শ্রম বিক্রি করেই।

বিরোধী দল অবরোধ করছে, প্রশ্ন হলো- কাকে? দেশ থেকে তারা রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করছে। তাতে কার ক্ষতি হচ্ছে? সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্যের বাসায় কি রান্না বন্ধ ছিল? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কি একদিনের জন্য বিরোধী দল তাঁর কার্যালয়ে বন্দি রাখতে পেরেছে? বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮দলীয় জোট হরতাল-অবরোধ না দিয়ে যদি তাদের দাবি পূরণ না হলে নির্বাচনে না আসত, তাহলে আসন্ন ৫ জানুয়ারি নির্বাচন এখনকার মতো গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতো না? কিন্তু রাজনীতিবিদদের হরতাল-অবরোধের মূল লক্ষ্য হলো, খাদ্য সরবরাহ, রোগীদের চিকিৎসা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবিকা, রপ্তানিকারকদের রপ্তানি, কারখানার কাঁচামাল আটকে দেওয়া। এখন সরকারকে টেনে নামানোর জন্য সাধারণ মানুষের পায়ে কুড়াল মারা হচ্ছে। কোন দল আন্দোলনে কত বেশি শক্তিশালী, সেটি হচ্ছে রাজনীতির মাঠের প্রধান আলোচ্য বিষয়। সরকার যতই দমনের চেষ্টা করছে, ততই মরিয়া বিরোধীরা।

 

মোদি-নীতিশ ও আমাদের দুই নেত্রী 

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে হরতাল-অবরোধের কথা ছিল না। কোন দল দেশকে কত দূর এগিয়ে নিল, সেটা দেখেই ভোটারদের ভোট দেওয়ার কথা ছিল। একটা নজির দেখানো যেতে পারে, পাশের দেশ ভারত থেকে- বিহার আর গুজরাট ভারতের দুই প্রান্তের দুই রাজ্য। বিহার থেকে গুজরাটে যেতে পাড়ি দিতে হয় এক হাজার ৮৫৭ কিলোমিটার। কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে এই দুই রাজ্যের প্রসঙ্গটি বারবার আসে দুই মুখ্যমন্ত্রীর কারণে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কড়া সমালোচক। একে অন্যকে কখনোই ছেড়ে কথা বলেন না। কিন্তু দুজনই ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয় তাঁদের উন্নয়ন কাজের কারণে।

ভারতে উন্নয়নের মডেল হিসেবে গুজরাটকে গণ্য করা হয়। পেছনে সাম্প্রদায়িকতার কালো দাগ থাকার পরও নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে জিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে চান। কিন্তু মোদিকে অযোগ্য দাবি করে তাঁকে হটাতে সব রকম চেষ্টা করছেন নীতিশ কুমার। কিন্তু দুই নেতার মধ্যে একটা বিষয়ে মিল আছে। তাঁরা দুজনেই নিজ রাজ্যকে উন্নয়নের নজির হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০৫ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নীতিশ কুমার তাঁর রাজ্যকে অনেক পেছন থেকে সামনে নিয়ে এসেছেন। অনেকে মোদির চেয়ে নীতিশ কুমারকে উন্নয়নের দিক দিয়ে এগিয়ে রাখেন।

নৃতাত্তি্বকভাবে ও জলবায়ুর দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তেমন কোনো পার্থক্য নেই, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য দিক দিয়ে মিলের দিকটিই বেশি। বৈপরিত্য রাজনীতিতে। বাংলাদেশের দুজন তুমুল জনপ্রিয় নেত্রীর একজনও এখন পর্যন্ত দেশবাসীর কাছে নিজেদের উন্নয়নের মডেল হিসেবে তুলে ধরতে পারেননি।

বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও ধর্ম বিরোধিতাকে প্রবলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর বিএনপির প্রতি আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে সখ্য ও পাকিস্তানপ্রীতির অস্ত্র ব্যবহার করেছে। উন্নয়নের অস্ত্রটি অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত থেকেছে, কারণ কোনো দলই এ ক্ষেত্রে পুরো সাফল্য দাবি করতে পারেনি।

বাংলাদেশে নির্বাচনে জয়ের জন্য উন্নয়ন যে মুখ্য অস্ত্র নয়, তার প্রমাণ হিসেবে সামনে আনা যায় চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে। ওই চার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরাজয়ের প্রধান কারণ হিসেবে মানুষ মনে করে যে গত ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থানের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযানে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।

বর্তমানে সরকারি দলের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের প্রধান অস্ত্র ধর্ম। এর পরের অবস্থানে আছে দুর্নীতি। আন্দোলনের নামে অর্থনীতির গতি টেনে ধরার পরও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। আবার আন্দোলন করে তারা ২০০৬ সালে অর্থনীতির ক্ষতি করেছিল। বিএনপি এবার একই পথ ধরেছে। দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ করে তারা অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এবার আন্দোলনে নতুন মাত্রা পেয়েছে ব্যাপকসংখ্যক পণ্যবাহী গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। এ সহিংসতার এ ধরনের মাত্রা আগে দেখেননি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

বর্তমানে দুই নেত্রী যেসব বিষয়কে প্রধান হাতিয়ার করে নির্বাচনে জেতার পথ খুঁজছেন, তার বদলে দেশের উন্নয়নকে ১৯৯১ সাল থেকে প্রধান হাতিয়ার করলে বাংলাদেশ এগিয়ে যেত। দুঃখজনকভাবে ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো উন্নয়ন প্রধান প্রভাবক নয়।

 

অর্থনীতির পথের কাঁটা নির্বাচন

৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট এখন ভূখণ্ডে বসবাস করে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। একবেলা নয়, তিন দিন না খেয়ে থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরা দরিদ্র মানুষের খোঁজ নেয় না। নিজে বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই মানুষ কাজ করে। একজন কৃষক এক মণ ধান ফলালে তাঁর পরিবারের এক মাসের চালের জোগান আসে। একজন শ্রমিক একটি শার্ট সেলাই করে যে মজুরি পান, সেটি দিয়ে তাঁর পরিবার চলে। সেই শার্টটি বিদেশে রপ্তানি করে একজন ব্যবসায়ী কিছু মুনাফা করেন। তা দিয়ে তাঁর সংসারের খরচ যেমন জোগানো হয়, তেমনি মুনাফা থেকে জমানো টাকা নতুন বিনিয়োগেও আসে। এসব কার্যক্রমের পুরোটাই যোগ হয় দেশের অর্থনীতিতে। দেশ এগিয়ে যায়।

কিন্তু নির্বাচন এলেই দেখা যায় সব কিছু থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, নির্বাচনের বছরগুলোতে অর্থনৈতিক সূচকগুলোর অবস্থা আগের বছরের তুলনায় খারাপ হয়ে যায়। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। পরের বছর তা কমে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছিল। ২০০০-০১ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। পরের বছর তা কমে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। পরের বছর তা কমে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল। তা কমে যাবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

 

গণতন্ত্রের বয়স বাড়ে, হরতাল-অবরোধের সংখ্যাও বাড়ে

হরতাল শব্দটি গুজরাটি ভাষা থেকে উদ্ভব হলেও প্রতিবাদের এ রাজনৈতিক কর্মসূচিটি তারা ততটা আপন করতে পারেনি, যতটা পেরেছে বাংলাদেশ! ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ‘তমুদ্দিন মজলিস’ প্রথম হরতাল ডাকার পর থেকে এ দেশের রাজনীতিতে জেঁকে বসেছে চরম এ কর্মসূচিটি। সামরিক ও স্বৈরাচার আমলে হরতাল হয়েছে, গণতান্ত্রিক আমলে হরতাল আরো বেড়েছে। যত দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে হরতালের সংখ্যা বাড়ছে। দিন এগিয়ে যায়, বছর পেরিয়ে যায়, গণতন্ত্রের বয়স বাড়ে। হরতাল-অবরোধও বাড়তে থাকে।

এ দেশের মানুষ জ্বালানি তেলের দাম কমাতে হরতাল দেখেছে, পছন্দের নির্বাচন ব্যবস্থার দাবিতে হরতাল দেখেছে, বিচার বাতিলের দাবিতেও হরতাল দেখেছে। এমনকি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার অবসরের মতো ‘উদ্ভট’ দাবিতে ডাকা হরতালের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এ দেশের আমজনতা।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সরকারব্যবস্থার চেয়ে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হওয়া গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় হরতাল অনেক বেশি হচ্ছে বিশ্লেষণ করে বের করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তাদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে তিন দিন, ১৯৭১ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে সাত দিন, ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রতিবছর ১৭ দিন ও ১৯৯১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৪৬ দিন করে হরতাল হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো হরতাল-অবরোধ এখন আর কোনো দেশে নেই। ভারতে মাঝেমধ্যে হরতাল বা বন্ধ পালন হয়। তবে তার মাত্রা খুবই কম। নেপালে মাওবাদীদের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই ও অতঃপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও হরতাল আছে। কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। অর্থনীতির অগ্রগতির যে নজির চীন তৈরি করেছে, তাতে হরতাল-অবরোধের কোনো কোপই ছিল না। বরং সে দেশে এ ধরনের কর্মসূচি নিষিদ্ধ। পাকিস্তানে সন্ত্রাস সব মাত্রা ছাড়িয়েছে। বোমা মেরে তারা বহু মানুষকে মেরে ফেলে। কিন্তু হরতাল নেই। তাই এত অস্থিরতার মধ্যেও পাকিস্তানের অর্থনীতি গতিশীল।

হরতাল বা বন্ধ-এর বিরুদ্ধে সব সময়ই কঠোর অবস্থান নিয়েছে ভারতের আদালত। ২০০৪ সালে বোম্বে হাইকোর্ট ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও শিবসেনাকে ২০ লাখ রুপি করে জরিমানা করে মুম্বাইতে বন্ধ আহ্বান করার দায়ে। বিজেপি ওই কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল একটি বাসে বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার প্রতিবাদে। ২০০২ সালের ২ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ের ঘাটকোপার এলাকায় বাসে ওই বিস্ফোরণে দুজন নিহত ও ৪৯ জন আহত হয়। অগ্নি নামের একটি বেসরকারি সংস্থা জোর করে বন্ধ পালন করাতে শহরের ৫০ লাখ রুপির ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করে আদালতে রিট করে।

 

টেনে নামানো চলছে থাইল্যান্ডেও, কিন্তু…

থাইল্যান্ডে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে টেনে নামাতে বিরোধীরা কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছে। তাদের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি সেই নির্বাচনের দিন ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা অভিজিত ভেজ্জাজিবা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।

বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীকে টেনে নামাতে কিন্তু হরতাল আহ্বান করেনি, কিংবা অবরোধ ডেকে দেশ অচল করার পথেও হাঁটেনি। তারা সভা করেছে, মিছিল করেছে, কার্যালয় ঘেরাও করেছে। কিন্তু সেটি ছিল একটি নির্দিষ্ট এলাকাকেন্দ্রিক। ওই দেশের পর্যটন এলাকা পাতায়া বা ফুকেটে পর্যটকরা বুঝতেও পারেননি, দেশের সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর আন্দোলন চলছে। এমনকি রাজধানী ব্যাংককেও নির্বিঘ্নে চলেছে যানবাহন ও ব্যবসা-বাণিজ্য।

কিন্তু বাংলাদেশে সরকারের চামড়া যেমন মোটা, তেমনি বিরোধী দল কোনো সময়ই চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যেতে দ্বিধা করে না। পাতায়ায় অবাধে বিদেশিরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেখানকার হোটেল-রেস্টুরেন্ট ধুন্ধুমার ব্যবসা করছে। আর বাংলাদেশের কক্সবাজার যেন বিরানভূমি। বিদেশিরা তো দূরের কথা, বাংলাদেশিরাই যেতে পারছেন না সেখানে। এ দেশে পোশাক কিনতে এসে বিদেশি ১১ জন ক্রেতা প্রতিনিধি হামলারও শিকার হয়েছেন।

 

দরিদ্র মানুষের দেশে হরতালের ক্ষতি ৬৪ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। কিন্তু সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোই আবার হরতাল-অবরোধ করে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করে। এই ৬৪ হাজার কোটি টাকা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। এক দিনের হরতালে কত ক্ষতি হয়- এর কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। বেসরকারি পরিসংখ্যানও গবেষণা-নির্ভর হয়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএনডিপি হিসাব করে বলেছিল, এক দিনের হরতালে সরাসরি ৫০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। তারপর গত ৮ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে। ফলে ক্ষতিও বেড়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) হিসেবে বছরে গড়ে ৪০ দিন হরতাল হলে ৬৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এক দিনের হরতালে ক্ষতি এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

হরতাল-অবরোধের কারণে অর্থনীতির এত ক্ষতি হলেও এসব কর্মসূচির দাবির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক খুবই কম। সিপিডির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৯৩ শতাংশ হরতালের কারণ ছিল রাজনৈতিক। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৯৬ শতাংশ হরতাল হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। এরপর থেকে এ বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ডাকা হরতালগুলোর মাত্র ৬ শতাংশ জনস্বার্থে ছিল। বাকি ৯৪ শতাংশ হরতালের কারণ ছিল রাজনৈতিক।

 

এখন প্রয়োজন সুস্থ ধারা

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুনজর বাংলাদেশের ওপর পড়ে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও এ দেশে অর্থনীতির গতি ধরে রাখার সামর্থ্য দেখে। মার্কিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককেনসি অ্যান্ড কম্পানি তাদের প্রতিবেদনে বলেছিল, আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশ থাকবে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর পোশাক কেনার ‘হট স্পট’। তাদের মতে, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার হবে।

আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান জেপি মরগান ২০০৭ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ হবে আগামীর অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাঁচটি দেশের একটি, যাদের তারা বলেছে ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’। আমেরিকার আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস্ ‘ব্রিক’ সদস্যভুক্ত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের পরে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে এমন ১১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও রেখেছে।

বাংলাদেশ নিয়ে বিপুল প্রত্যাশার কথা বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও। গত ২৬ মার্চ জাতিসংঘে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিবাচক আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক কারণ আছে। দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রশমনে বাংলাদেশ বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করছে। টেকসই উন্নয়ন ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য অর্জনকারীদের শীর্ষে আছে এ দেশ।’

মন্দার মধ্যেও বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার একটি বাংলাদেশ। তাই সব সময় সমালোচনায় পটু বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশকে বলেছে ‘এক অমীমাংসিত বিস্ময়’।

একসময় বিশ্বের বড় বড় সব কম্পানি চীনে আস্তানা গাড়তে শুরু করেছিল সে দেশের সস্তা শ্রমের কারণে। রাজনৈতিক হানাহানি না থাকা আর বিনিয়োগের নিরাপত্তার কারণে আন্তর্জাতিক কম্পানিগুলো সে দেশে কারখানা খুলতে বাধ্য হয়। কিন্তু চীনেও ইদানীং মানুষের জীবনমানের সঙ্গে শ্রমের মূল্য বাড়ায় বিশ্বখ্যাত কম্পানিগুলো এখন সস্তায় পণ্য বানাতে নতুন দেশ খুঁজছে। জেপি মরগান আর গোল্ডম্যান স্যাকসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়ন তালিকায় সামনের দিকে রেখেছিল বাংলাদেশকে। আর বাংলাদেশের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের বড় কারণ ১৬ কোটি মানুষের বিশাল বাজার। এর সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পৃথিবীর বড় বড় বাজারগুলোতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার। সহজে প্রশিক্ষণযোগ্য বিপুল শ্রমশক্তিও এ দেশের বড় সম্পদ। উৎপাদন খরচও এ অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম। পাশাপাশি আছে বিদেশি বিনিয়োগের উদার নীতি।

এখন বাংলাদেশের কেবল প্রয়োজন সুস্থ ধারার রাজনীতি। রাজনীতিবিদরা দেশকে শুধু এটুকু দিতে পারলে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষক-শ্রমিকের শক্ত হাত আছে, উদ্যোক্তার দূরদর্শিতা ও টিকে থাকার ক্ষমতা আছে, জনগণের দেশের প্রতি ভালোবাসা আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতেই হয়তো বাংলাদেশকে আমরা দেখতে পারব মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে। তখন গরিবের পাতে আরো বেশি ভাত মিলবে। হয়তো শুধু সবজির বদলে মাছ-মাংসও জুটবে তাদের। সন্তানরা বিদ্যালয়ে যাবে। বাংলাদেশ শুধু পোশাক সেলাই করবে না, বাংলাদেশি কোনো ব্রান্ডই হয়তো দোকান খুলবে প্যারিস-লন্ডনের ব্যস্ততম এলাকায়। কিন্তু এ জন্য পথ দেখাতে হবে রাজনীতিবিদদেরই।