CPD study on RMG cited, published in The Daily Manobkantha on Tuesday, 9 September 2014.
পোশাক শিল্পে অশনি সংকেত
হিটলার এ. হালিম
ন্যূনতম মজুরির দাবি আদায়ে পোশাক শ্রমিকদের অব্যাহত বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও আন্দোলনে তৈরি পোশাক শিল্প অশান্ত হয়ে উঠেছে। টানা চারদিন ধরে চলা এ আন্দোলন এখন গার্মেন্টসের জন্য অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকারের শেষ সময়ে এসে হঠাৎ এ আন্দোলনের মূল ইস্যু শুধুই মজুরি না, এর পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য রয়েছে তা খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, হঠাৎ আন্দোলনে শ্রমিকদের কারা ইন্ধন দিচ্ছে এবং বিক্ষোভ উসকে দিতে কারা কাজ করছে তাদের খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়া এবং চলমান টানা বিক্ষোভ পেশাক খাতকে একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে নির্ধারিত সময়ে রফতানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্যের জাহাজিকরণ (শিপমেন্ট) বাতিল হওয়ার আশঙ্কা করছে মালিকপক্ষ। যদিও একাধিক গার্মেন্টস মালিক মানবকণ্ঠকে জানিয়েছেন, এই আন্দোলনে তাদের অন্তত একটি হলেও জাহাজিকরণ বাতিল হয়েছে। শিগগিরই সরকার, গার্মেন্টস মালিকপক্ষ এবং শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে সমস্যা সুরাহারও জোর দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। যদিও সমস্যার সমাধানে সোমবার রাতেই সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় মালিক পক্ষের তোপের মুখে পড়েছিলেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। এ সময় মন্ত্রীকে ঘিরে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়েছে বলে জানা গেছে। মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। সোমবার রাতে মঙ্গলবার সব গার্মেন্টস খুলে দেয়ার কথা জানানো হলেও শ্রমিকরা তাদের দাবিতে অনড় থাকে। মঙ্গলবার সকালে শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখালে গাজীপুরের কয়েকটি পোশাক কারখানায় ছুটি দেয়া হয়। শ্রমিকরা কালিয়াকৈরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে। ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জেও শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করে।
প্রসঙ্গত, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দাবি (৮ হাজার টাকা) আদায়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শ্রমিকদের সমাবেশে আয়োজন করে নৌমন্ত্রীর সংগঠন গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। গাজীপুর এলাকার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে মহাসমাবেশে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মালিকপক্ষ তাদের বাধা দেয়। এতে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখায়, কারখানায় ভাঙচুর চালায়। এতে করে গাজীপুরের পোশাক কারখানাগুলো সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একাধিক গার্মেন্টস মালিক অভিযোগ করেন, নৌমন্ত্রী হঠাৎ করে ওই সমাবেশ না ডাকলে শ্রমিকরা বিক্ষোভের নামে ভাঙচুর চালাত না।
শ্রমিকরা যখন ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলনে নামে তখন ওইদিনের সমাবেশে নৌমন্ত্রী মালিকপক্ষের উদ্দেশে দর-কষাকষির মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছার পরামর্শ দেন। নৌমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর শ্রমিকদের একটি অংশের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই সময়ে নৌমন্ত্রী হঠাৎ কেন শ্রমিক সমাবেশ আয়োজন এবং মজুরির বিষয়ে কথা বললেন তা খতিয়ে দেখতে অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন নির্বাচনকে সামনে রেখে গার্মেন্টস খাত নিয়ে অনেক ধরনের মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহলও নানান অপচেষ্টায় লিপ্ত। এ কাজে শ্রমিক নামধারী বহিরাগতদের ব্যবহার করা হচ্ছে।’ তিনি জানান, রাজনৈতিক কারণে শ্রমিকদের পুঁজি করে তারা ভোটের রাজনীতি করছেন। তারা মালিকদের কাছ থেকে দাবি আদায়ের এটিকে অন্যতম সময় হিসেবে দেখছেন।
এদিকে গতকাল একটি অনুষ্ঠানে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী গার্মেন্টস মালিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা মাত্র ৬০০ টাকা মজুরি বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন। আমি জানতে চাই কোন যুক্তিতে এটা আপনারা করতে পারলেন। আপনারা কি পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে মশকরা করছেন?’
ওদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গার্মেন্টস খাতে এই নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, ‘নৌপরিবহনমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার পোশাকশিল্পকে ধ্বংসের চক্রান্ত করছে।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পোশাক শ্রমিকদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করে গতকাল আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে শ্রমিকদের মজুরি কমপক্ষে ৮ হাজার ২১৬ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। সিপিডি বলেছে, দারিদ্র্যসীমা, মাসিক ব্যয় এবং প্রত্যাশিত ব্যয়ের কথা চিন্তা করে দেশের একজন পোশাক শ্রমিকের শুরুতেই ৬ হাজার ৫৬০ টাকা বেতন হওয়া উচিত।
সিপিডির মজুরি বিষয়ক প্রস্তাবনার সম্পর্কে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি এসএম মান্নান কচি মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘সিপিডির প্রস্তাব অনুযায়ী মজুরি দিতে গেলে কোনো পোশাক কারখানায় আর চালু রাখা যাবে না।’ আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে গঠিত ওয়েজ বোর্ড ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে দেবে।’
তবে শ্রমিকদের মজুরি ৮ হাজার টাকা করতে হলে বায়ারদেরও (ক্রেতা) পোশাকের মূল্য বাড়াতে হবে বলে জানান গাজীপুরের জে অ্যান্ড জে ডিজাইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেমস পি. মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা যদি পোশাক প্রতি ৫০ সেন্ট দাম বাড়িয়ে দেয় বা আমাদের বেশি দেয় তাহলেই কেবল পোশাক শ্রমিকদের ৮ হাজার টাকা বেতন দেয়া সম্ভব। তিনি ক্রেতাদের দরকষাকষি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘তারা মাত্র ১ সেন্টের (প্রায় ৮০ পয়সা) জন্য অর্ডার বাতিল করে অন্যকে দিয়ে দেয়। তাহলে কীভাবে আমরা পোশাকের দাম বাড়িয়ে শ্রমিকদের বেশি বেতন দেব।’
জানা গেছে, এই আন্দোলনে ভালো গার্মেন্টস বলে স্বীকৃত, যারা মাসের তিন থেকে পাঁচ তারিখের মধ্যে বেতন দিয়ে দেয়, কারখানার পরিবেশ উন্নত, বেতনও অপেক্ষাকৃত অন্যান্য গার্মেন্টসের তুলনায় ভালো, সেসব গার্মেন্টসের শ্রমিকেরাও পথে নেমেছে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গার্মেন্টস মালিক মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার তার মেয়াদের শেষ সময়ে এসে দেশের শান্ত পরিস্থিতি অশান্ত করতেই এ ঘটনার জন্ম দিয়েছে। যাতে বিরোধী দলকে ফাঁসানো যায়। তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তিনি মাঠে নেমেছেন। সামনে ভোট আসছে। সরকার শ্রমিকদের বেতন বাড়িয়ে ভোটের একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা করে যাবে।’ তিনি বিজিএমইএ নেতাদের উল্লেখ করে বলেন, ‘নেতারা এখনো সরকারের প্রস্তাবে না না করছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাও হ্যাঁ করবেন। সরকার তাদের কৌশলে ম্যানেজ করে আমাদের মতো ছোট ছোট ব্যবসায়কে বিপদে ফেলতে আদাজল খেয়ে লেগেছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বিদেশি পোশাক ক্রেতা বাংলাদেশে এসে পাঁচতারা হোটেলে উঠছে। সেখানে বসে তারা বিভিন্ন গার্মেন্টস মালিকদের ডেকে কাজের অফার করে থাকেন। যিনি কম দামে কাজটি করে দিতে সম্মত হন কাজটি দেয়া হচ্ছে। ফলে দামাদামির কোনো সুযোগই থাকছে না।
এ ব্যাপারে ঢাকা চেম্বারের (ডিসিসিআই) সভাপতি মো. সবুর খান মনে করেন, এই আন্দোলনের পেছনে কোনো রাজনৈতিক খেলা থাকতে পারে। তা না হলে, এ সময় এই আন্দোলন কেন। তিনি বলেন, ‘বিজিএমইএ এবং পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে তথ্যগত যোগাযোগের ঘাটতি আছে। ৩ হাজার টাকা বেতন মানে তো ৩ হাজার টাকাই নয়। এটা একজন অদক্ষ শ্রমিকের কাজ শুরুর বেতন। এর সঙ্গে রাত্রিকালীন ডিউটি এবং ওভার টাইম বা অতিরিক্ত কাজ করে একজন শ্রমিক মাস শেষে হাতে পায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। তাছাড়া দক্ষ হয়ে উঠলে সে আরো বেতন পায় বা ভিন্ন কারখানায় যোগ দেয়। এই তথ্যগুলো কেন যে বিজিএমইএ নেতারা সব মহলের সঙ্গে শেয়ার করেন না তা আমার বোধগম্য নয়।’
– See more at: http://www.manobkantha.com/2013/09/25/140236.html#sthash.0l02UxQF.dpuf