Published in Manobkantho on Sunday, 26 July 2015.
দৌড়ঝাঁপ বিফলে উন্নয়ন কাজে ভাটা
জাহাঙ্গীর আলম
সরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়াতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দ্রুত এগিয়ে যেতে গত অর্থবছরের প্রথম থেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন কাজে গতি বাড়াতে সচিব থেকে শুরু করে প্রকল্প পরিচালকদের সঙ্গে ঘন ঘন মিটিং করে জোর তাগিদ দেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তিনি বারবার বলেছিলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি শতভাগ বাস্তবায়ন করতেই হবে। কিন্তু তারপরও বছর শেষে সে লক্ষ্য তো দূরের কথা, সংশোধন করেও আগের চার বছরের চেয়ে পিছিয়ে গেল। যদিও স্বাধীনতার পর ৪ বার অর্জন হয়েছে শতভাগ এডিপি। প্রকল্প পরিচালকদের অনীহা ও সদিচ্ছার অভাবের সঙ্গে হঠাৎ করে রাজনৈতিক সহিংসতার তাণ্ডবের ছোবলে এমন অবস্থা। যা সরকারের জন্য সন্তুষ্টির নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় বড় প্রকল্পে গতি ফেরেনি। তাই উন্নয়ন কাজের গতি বাড়াতে ও অপচয় কমাতে আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উন্নয়ন কাজে গতি বাড়াতে গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রথমে ৮০ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হলেও কয়েকমাস যেতে না যেতে বাস্তবায়নের হার কমতে থাকায় কাটছাঁট করে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সংশোধিত এডিপির অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৫০ হাজার ১০০ কোটি এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ২৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সংশোধনের সময় এমনকি তার আগেও পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছিলেন, দেশের স্বার্থেই শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন করতে হবে। এগিয়ে নিতে হবে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, গেল অর্থবছরেও হোঁচট খেতে হলো উন্নয়ন কাজে। গত জুনে সমাপ্ত হওয়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার দাঁড়িয়েছে ৯১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বছরজুড়ে ৫৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অর্থব্যয় করেছে প্রায় ৭১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। তবে আর এডিপি বাস্তবায়নের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। যেমনটি এর আগে ১১ মাসের বাস্তবায়নের তথ্য তুলে ধরে।
অনেক চেষ্টা করে গত অর্থবছরে উন্নয়ন কাজের কমতির চিত্র হলেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এডিপির অর্থ ব্যয় হয়েছিল ৫৬ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৫ শতাংশ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫০ হাজার ৩৫ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়ন হয়েছিল ৯৬ শতাংশ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ৩৮ হাজার ২৩ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়ন হয়েছিল ৯৩ শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১০-১১তে ৩২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা ব্যয় করে এডিপি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল ৯২ শতাংশ।
এক মাস আগে আইএমইডি জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) বাস্তবায়নের হার ছিল ৬৭ শতাংশ। ওই সময়ে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, এক মাস বাকি আছে। তাতে ৩০ শতাংশ অর্জন হতে পারে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বর্ষা থাকায় তেমন কোনো কাজই হয় না। শেষ প্রান্তিকেই হয়ে থাকে। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। এর সুফল আগামীতে পাব। প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) তাগিদ দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু এক মাসের ব্যবধানে বাস্তবায়ন হার বেড়েছে ২৪ শতাংশ। মোট বাস্তবায়ন হয়েছে ৯১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
মূলত সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয়গুলোকে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া হলেও সেই অর্থ তারা খরচ করতে পারেনি। কয়েক দফা পর্যালোচনা বৈঠক করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থ ব্যয় করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এর পরও কিছু মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। শত চেষ্টা করেও কেন গতি বাড়েনি উন্নয়ন কাজে এমন প্রশ্নের ব্যাপারে গতকাল মানবকণ্ঠকে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সদস্য প্রফেসর ড. শামসুল আলম বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। এডিপি বাস্তবায়নে যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়া প্রথম থেকে। কিন্তু তা হলো না। প্রায় ৯২ শতাংশ হয়েছে। ৯৫ শতাংশ হলো সরকার সন্তুষ্ট হতো। হঠাৎ করে জানুয়ারি থেকে ৩ মাস রাজনৈতিক তাণ্ডবলীলায় অনেক ক্ষতি হওয়ায় এ অবস্থা বলে তিনি মনে করেন। পিডিদের অনীহাও কি এর জন্য দায়ীÑ এমন প্রশ্নের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা তো মন্ত্রী মহাদয় মিটিংয়ে প্রকাশ্যে বলেছেন। কাজেই নতুন করে বলার কিছু নেই।
সময় ও অর্থের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেক সভায় সব প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। তারপরও অনেক পিডি বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢিলেমি করে থাকেন। তা আঁচ করে স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেছেন, অনেক প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মাত্র ৫ ভাগ কাজ জিইয়ে রেখে সংশোধনের জন্য উপস্থাপন করেন। আবার অনেকেই একটি প্রকল্প শেষ না করেই আরেকটি প্রকল্প শুরু করতে চান। এতে অর্থের অপচয় ও সময় নষ্ট হয়। এটা আর করতে দেয়া হবে না। সংশোধন করেও শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে পরিকল্পনামন্ত্রী এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। কোনো কিছু পরিবর্তন করতে হলে কিছু সময় লাগবে। হঠাৎ পরিবর্তন আসে না। কোনো সরকারের আমলেই শতভাগ সাফল্য হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, তদারকির অভাবসহ নানা কারণে প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ করা যায় না। এডিপি বাস্তবায়ন বাড়াতে বছরের পর বছর ধরে গবেষণা হয়েছে। চিহ্নিত এসব সমস্যা এখন পুরনো। কিন্তু এগুলোর সমাধান বা উত্তরণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ফেলো তোফিকুল ইসলাম খান বলেন, বিদেশি সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে গতি ফেরেনি। পদ্মা সেতুসহ বড় বড় প্রকল্পেরও একই অবস্থা। এছাড়া সম্ভাব্য সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যাও কমে গেছে। তাই উন্নয়ন কাজে গতি কমে গেছে। তিনি বলেন, বাস্তবতা মেনেই আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার। তবেই কাজে গতি ফিরবে।
আইএমইডি সূত্র মতে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সব সরকারই ক্ষমতায় এসে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়নের কথা বলে। কিন্তু দীর্ঘ ৪০ বছরে বাস্তবায়ন হয়েছে হয়েছে মাত্র ৪ বার। কোনো বছরেই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার প্রকল্প সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৫৬ শতাংশ। এর ৫ বছর পর ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে ১০৪ শতাংশ, ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন হয়। এরপর দীর্ঘ ৮ বছর পর ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে ১০১ শতাংশ এবং সর্বশেষ ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে ১১২ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়নের রেকর্ড সৃষ্টি হয়ে আছে। এরপর দুই যুগ কেটে গেছে। শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি এডিপি। বিদায়ী অর্থবছরেও সেই পথে থাকল সরকার। এতে বাড়ছে রাষ্ট্রের খরচ। একই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্পের বোঝাও বাড়ছে।