Published in The Daily Inquilab on Tuesday, 23 June 2015.
বিদেশে অর্থ পাচার বাড়ছে
আজিবুল হক পার্থ
দেশের অর্থ বিদেশে পাচার যেন মহামারী রূপ ধারণ করেছে। কোনো পদক্ষেপেই বন্ধ হচ্ছে না পাচার। গত চার দশকে বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। ২০১৪ সালে শুধুমাত্র সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিরা জমা করেছে ৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দাবি ব্যাংকের মাধ্যমে এখন আর টাকা পাচার হয় না। তবে বিশষজ্ঞরা মনে করেন, টাকা পাচারের জন্য একের পর এক নতুন কৌশল তৈরি করছে অসাধু চক্র। অবৈধ পথে টাকা নেয়ার পাশাপাশি বাণিজ্যের আড়ালেও পাচার হচ্ছে টাকা। এছাড়া প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশ থেকে যাচ্ছে দেশের বাইরে। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে কালো ছায়া নেমে আসবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, দেশের অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হলেও প্রতিকারে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে দেশ ব্যর্থ হচ্ছে।
আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকরী যে সমস্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেসব ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এবং বিনিয়োগের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণেই দেশের অর্থপাচার হচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মানি চেঞ্জার ও হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হচ্ছে। টাকার পাচারের প্রধান খাত হিসাবে আমদানি ব্যায় বেশি ও রপ্তানি আয় কম দেখানোকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষত্রে রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন তারা।সূত্রমতে, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে অর্থপাচার বেড়েছে সোয়া ৩৯ শতাংশ। যার পরিমাণ ১ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। ২০১০ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১২৪ কোটি টাকা, শতকরা হিসাবে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫৮ শতাংশ। ২০১১ সালে সাড়ে ৩৫ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১২ সাল থেকেই আবার শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফলে ২০১২ সালে আবার অর্থপাচারের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬১ কোটি টাকা, শতকরা হিসাবে বেড়েছে পৌনে ৫১ শতাংশ। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রকট আকার ধারণ করলে অর্থ পাচার আরও বেড়ে ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়, শতকরা হিসাবে প্রায় ৬২ শতাংশ। পাচার করা টাকার হিসাবে যা ছিল বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৪ সালে এর পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা, শতকরা হিসাবে পৌনে ৪১ শতাংশ।বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি, দেশের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পারিপার্শ্বিক প্রয়োজনের কারণে দেশে বসবাসের জন্য অনেকেই নিরাপদ মনে করেন না। এ জন্যই স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য উচ্চবিত্ত পরিবারের বেশিরভাগই বিদেশনির্ভর। এরই ধারাবাহিকতায় অর্জনের সবটুকুু দেশে রাখতে চাইছেন না বিত্তশালীরা। এতে করে একদিকে যেমন নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্যের জন্য বিদেশে যাচ্ছে অন্যদিকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও দেশের তুলনায় বাইরের কোন দেশকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এই কারণেই অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী প্রদক্ষেপ নেয়া যাচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইনকিলাবকে বলেন, সুইস ব্যাংকের সব টাকা পাচার করা অর্থ না। আবার দেশের সব কালো টাকা যে অবৈধ পথে যাচ্ছে সেটিও ঠিক নয়। মূল সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তিনি বলেন, পাচারের টাকার বড় অংশ যাচ্ছে বাণিজ্যের নামে। এটি বন্ধ করতে হবেসঠিকভাবে তদারকির মাধ্যমে। এছাড়া আমাদের সব প্রবাসী আয় দেশে ফিরছে না সেটিতেও মনোযোগী হতে হবে। দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ জন্য যেকোনো একটি দিক বিবেচনা করলে হবে না। বাজেটে কিছু খাতে প্রণোদনা দিয়ে পাচার বন্ধ করা যাবে না।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিশেষ করে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জমির সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। তিনি মনে করেন, সরকার পাচর বন্ধে যথেষ্ট উদ্যোগী। তবে মুদ্রা-পাচার রোধের সব আইন সঠিকভাবে কাজ করছে না, সেটি দেখতে হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, হুন্ডি, রপ্তানি ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং (কমমূল্য দেখানো) ও আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের (বেশি মূল্য দেখানো) মাধ্যমে দেশের টাকা পাচার করা হচ্ছে। কর ফাঁকি দেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন ও তাদের অনুসাীি ব্যবসায়ীরা অর্থপাচারে জড়িত থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছর পর্যন্ত টাকা পাচার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এর কারণ হলো দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ নেই। ফলে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগে স্থবিরতার পরও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এটি অস্বাভাবিক। এর অর্থ হলো ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে।
জানা গেছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন বন্ধে বাংলাদেশ সুইজারল্যান্ডসহ ১৪৭টি দেশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘এগমন্ট গ্রুপ’ এর সাথে গত জুলাই ২০১৩ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করায় টাকা পাচারের তথ্য সহজে পেতে পারে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সন্দেহভাজনদের সুনির্দিষ্ট নাম দিয়ে তথ্য চাইতে হবে। এক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডসহ সম্ভাব্য পাচারের অর্থ জমা আছে এমন দেশগুলোর সাথে চুক্তি করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে ১৭টি দেশের সাথে এধরনের চুক্তি করেছে। তাছাড়াও জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করায় বাংলাদেশ সকল প্রকার দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালো অর্থের উৎস বন্ধ এবং সুইস ব্যাংকসহ ‘কর-স্বর্গ’ বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত সকল অবৈধ অর্থ উদ্ধারে সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে, রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. আবু আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, দেশের সামগ্রিক পরিবেশের কারণে বিদেশে অর্থপাচার বাড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের বিত্তবানদের অনেকে নিজ দেশে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে না করায় দেশের বাইরে অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন দেশের বাইরে বিনিয়োগ বা অর্থপাচারের এই ধারা অব্যাহত থাকবে।তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যতোই আইন প্রণয়ন করা হোক, যতই কড়াকড়ি নিয়ম হোক মানুষের অর্জিত টাকা দেশে বিনিয়োগ এবং পরিবারসহ দেশে বসবাসের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে অর্থপাচার বন্ধ করা সম্ভব না।
আন্তর্জাতিক আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব দিয়ে লাভ নাই কারণ গরীব দেশের টাকা পাচার হয়ে ধনী দেশে যায়। তাই ধনী দেশগুলো পাচার বন্ধে কখনোই এগিয়ে আসবে না। জানা গেছে, ২০০৭ সালে ব্যাপক অংকের টাকা জমা হয় সুইস ব্যাংকে। এর পরে প্রতি বছরই বাড়ছে এই জমা। এছাড়াও অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশিদের টাকা জমা হচ্ছে। একদিকে সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য নানা প্রণোদনামুলক নীতি গ্রহণ করে আসছে। বিভিন্ন খাতে ছাড় ভর্তুকিও দিচ্ছে। এর উপর দেখা যাচ্ছে দেশের নাগরিকরা বিদেশমুখী হচ্ছে। ২০১৪ সালের মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছে ২৯২৩ জন বাংলাদেশি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, পাচার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর যে সহযোগিতা ও সমন¦য় থাকা দরকার, তা নেই। আর এ কারণেই এ খাতের অপরাধমূলক কর্মকা- তুলনামূলকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কাস্টমস, স্বারষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দেন।