Published in Prothom Alo on Monday, 10 August 2015.
সরল গরল
দেশেই ‘কঠিন, নোংরা ও বিপৎসংকুল’ চাকরি চাই
মিজানুর রহমান খান
সরকারের পিয়ন পদেও যে দেশে লাখ টাকায় চাকরি মেলে না, সেই দেশে মাত্র ৬০ হাজার টাকা খরচ করেই মালয়েশিয়ায় চাকরি মেলা সম্ভব। কিন্তু এই অবস্থাটি একটি দেশের পরিচালনাগত শক্তি নয়, দুর্বলতা প্রকাশ করে। উন্নয়ন আলোচনার সর্বত্র রেমিট্যান্সের গল্প। নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ থেকে আরও ওপরে ওঠার গল্প (মাথাপিছু নিচে ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ওপরে ৪ হাজার ১২৫ ডলার পর্যন্ত উপার্জনকারী দেশকে নিম্ন–মধ্যম আয় ধরা হয়, বাংলাদেশ রয়েছে নিচের সীমায়) আমরা যখন শুনছি, তখন মনে রাখব যে এই জিএনপির বড় খাত বিদেশি মুদ্রা, আর এতে গরিবের রক্ত লেগে থাকে। এখন মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদ আবারও ‘কঠিন, নোংরা ও বিপৎসংকুল’ খাতে ১৫ লাখ বিদেশি শ্রমিক এবং তা প্রধানত বাংলাদেশ থেকে আমদানির সংকল্প ব্যক্ত করেছেন বলে ৮ আগস্ট স্ট্রেইট টাইমস–এ খবর বেরিয়েছে।
উন্নত দেশ ও গণতন্ত্রের নিরঙ্কুশ রেমিট্যান্স–নির্ভরতা নেই। ৫২৬ বিলিয়ন ডলারের (২০১২) বৈশ্বিক রেমিট্যান্সের মধ্যে ৪০১ বিলিয়ন ডলার যায় উন্নয়নশীল বা তুলনামূলক গরিব দেশে। তাজিকিস্তানের জিডিপির অর্ধেক ও কিরগিজ প্রজাতন্ত্রের জিডিপির এক-তৃতীয়াংশের জোগানদার রেমিট্যান্স। বর্তমানে আমাদের ২৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের অর্ধেকের বেশি রেমিট্যান্স।
আমাদের দুই রপ্তানি খাত সব থেকে বড়। পোশাক ও মানুষ রপ্তানি। পোশাকে রানা প্লাজার রক্ত আর রেমিট্যান্সে গণকবরের কলঙ্ক। সুশাসন না দিতে পারার কারণে দেশে বিনিয়োগ ও কারখানা সৃষ্টি হয় না। একইভাবে সুশাসন না দিতে পারার কারণেই রানা প্লাজা ঘটে, মানুষ জান বাজি রেখে হিংস্র দালাল ও সমুদ্রকে টেক্কা দিয়ে টাকা উপার্জন করতে যায়। মেধাবীরা নিজেদের পাইকারি পাচার করে দেন, পরে পরিবারকেও টেনে নেন।
আর রানা প্লাজা হবে না, আর গণকবরের সন্ধান মিলবে না, সেই নিশ্চয়তা শাসকেরা দিতে অক্ষম। তাঁরা সক্ষম এই নিশ্চয়তা দিতে যে ‘গণতন্ত্র’ টেকাতে ২০১৯ সালের আগে নির্বাচন হবে না। তাঁরা অক্ষম এ কথা বলতে যে ২০১৯ সালের মধ্যে কত লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। সরকারিভাবে যদিও বেকারত্বের হার সাড়ে চার ভাগ, কিন্তু সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান জানালেন, যথেষ্ট কাজ পান না কিংবা পূর্ণ কর্মসংস্থানে নিয়োজিত নন, তাঁদের সংখ্যা প্রায় ২৫ ভাগ।’
গত সাত দিনে কাজ করেছেন কি? এই প্রশ্নের ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপ করে সরকার, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের কাছ থেকে আমি এটা শুনলাম। বেকারত্ব, নতুন চাকরি সৃষ্টি রাজনীতিতে ঝড় তোলে না। ক্রমান্বয়ে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বছরে দেশের শ্রমবাজারে ঢোকে ২০ লাখ আর নতুন ‘কর্মসংস্থান’ সৃষ্টি হয় প্রায় ১৭ লাখ। এর মানে, বছর গড়ালেই বেকারের সংখ্যা বাড়ে প্রায় তিন লাখ। বাগাড়ম্বরপ্রিয় আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা আমাদের বলুন, গত ছয় বছরে বেড়ে ওঠা এই ১৮ লাখ নতুন বেকার কবে চাকরি পাবেন?
আগে তবু রপ্তানি বৈচিত্র্যের কথা শোনা যেত, কত টাকা এফডিআই এল, গর্বভরে তার অঙ্ক বলতে শুনতাম। এখন আর তা শুনি না। রপ্তানিমুখী রপ্তানি খাত মূলত সৃষ্টি করেছে বিদেশিরা, তাদের শর্তে ও প্রয়োজনে। কোনো দিন এর প্রয়োজন ফুরালে তারা চলে যাবে। আমরা এর ওপর যত বেশি নির্ভরশীল থাকব, ধস নামলে ততটাই পথে বসব। জনশক্তি রপ্তানির বিদেশি বাজার ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে এবং হবে। মানুষ ও পোশাক রপ্তানি আমাদের যত বড় শক্তি, তত বড় দুর্বলতা।
জুলাইয়ের শেষ শুক্রবার প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নবনিযুক্ত মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গে তাঁর বাসভবনে আলাপকালে তাঁকে এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিলাম। কারণ, তিনি আলোচনার শুরুতেই যথারীতি বিদেশে বেশি লোক পাঠানোর স্বপ্ন দেখালেন। বললেন, ‘রপ্তানির চেয়ে রেমিট্যান্সের মূল্য বেশি। কারণ, পোশাকের টাকার একটা অংশ ব্যাক টু ব্যাক এলসির কারণে বিদেশে ফেরত যায়।’ তাঁকে আমি গণকবরের কথা স্মরণ করিয়ে দিই।
মন্ত্রী জানালেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যেতে পারেন। সৌদি আরব বাংলাদেশি গৃহপরিচারিকা আমদানিতে সাড়া না পেয়ে অন্যান্য দেশ থেকে আনার কথা ভাবছে। আমাদের মন্ত্রী যদিও ‘পুরুষ ৭৫ ও নারী ২৫ ভাগ’ রপ্তানির কথা বলেছেন, কিন্তু সৌদিরা প্রধানত গৃহপরিচারিকাই চাইছেন। এমনকি সৌদি সরকার ১ জুন থেকে এই নতুন বিধান কার্যকর করেছে যে মোট বিদেশি জনশক্তি আমদানির অন্তত ২৫ ভাগ সেই সব দেশ থেকে আনতে হবে, যারা সৌদিতে গৃহপরিচারিকা পাঠায়। ক্ষুব্ধ ভারত এটা জেনে সব ধরনের শ্রমিক প্রেরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আমাদের মন্ত্রী দেশে এ কথা রাষ্ট্র করেননি।
বাংলাদেশি শ্রমিক আমদানির কথা বলায় মালয়েশিয়ার সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনেক আগেই সমালোচনার কবলে পড়ে। তাদের এক মন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, স্থানীয়রা কেউ এসব চাকরি করবে না। আসলে গণতন্ত্র হরণ করে তাদের সদাশয় স্বৈরশাসক মাহাথির মোহাম্মদ এমনই এক মালয়েশিয়া গড়েছেন, যেখানকার নাগরিকেরা এখন ‘থ্রি ডি’ চাকরিকে না বলতে পারছেন। থ্রি ডি হলো ‘ডিফিকাল্ট (কঠিন), ডার্টি (নোংরা) ও ডেঞ্জারাস (বিপৎসংকুল)’। আশ্বস্ত হলাম জেনে যে আমাদের প্রবীণ প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী এই তথ্য জানেন। বললেন, ওই মন্ত্রী এখন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী। দেশটির সাবা প্রদেশের বিরোধী দলের নেতা লি ১ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানির উদ্যোগের সমালোচনা করে বলেন, সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধিতে বিদেশি শ্রমিকদের ভূমিকা আছে। এই মুহূর্তে নিম্ন–মধ্যম আয়ের স্কেলের তলানিতে থাকা দেশের রাজনীতিকেরা, যাঁরা কেউ জানেন না যে বিশ্বব্যাংকের স্কেলে ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ ডলারের মাথাপিছু আয়সীমায় কবে পেঁৗছাবেন, তাঁরা কবে আত্মমর্যাদার দিকে নজর দেবেন, তা জানি না। তবে আপাতত বিদেশে থ্রি ডি চাকরি গ্রহণে উৎসাহিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কবে দেশেই প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার থ্রি ডি মার্কা কর্মসংস্থান করতে পারবেন, সেই স্বপ্নটা অন্তত দেখান।
সরকারি রিপোর্টই বলছে, দেশের শ্রমবাজারে প্রতিবছর ২০ লাখ তরুণ ঢুকছেন। মন্ত্রী বললেন, তিনি চট্টগ্রামে একটি মেরিন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট গড়বেন। বললাম, বাংলাদেশ সমান সমুদ্রসীমা পাওয়ার পরও কিন্তু চলো সমুদ্রে যাই স্লোগান তোলা হলো না। শয়ে শয়ে তরুণ যাঁরা জীবন বাজি রেখে উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে বিদেশি জলসীমায় বন্দুকের নল অগ্রাহ্য করে যেতে পারেন, তাঁদের আপনি মেরিন কাজের প্রশিক্ষণ দিন। কৃষি ব্যাংকের মতো সমুদ্র ব্যাংক তৈরি করুন, যাঁরা আমাদের তরুণদের সার ও কীটনাশক কেনার মতো বোট ও মাছ ধরার উপকরণ কিনতে সুদমুক্ত ঋণ দেবে। এ কাজ কঠিন, নোংরা ও বিপজ্জনক হলেও দেশের সীমায় তাঁরা এটা হাসিমুখে করবেন। নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে ম্লান হেসে প্রবীণ মন্ত্রী বললেন, তিনি এই প্রস্তাব ভেবে দেখবেন।
আমাদের ৮৬ লাখ প্রবাসী কর্মী প্রকৃত জনসম্পদে পরিণত হচ্ছেন না, তাঁদের ৯০ ভাগই অদক্ষ। তাঁদের অনেকে উগ্র মৌলবাদী সংস্কৃতিও বয়ে আনছেন; ৩৭ ভাগই থাকেন সৌদি আরবে। আমিরাতে ২৬, মালয়েশিয়ায় ১০, কুয়েতে ৭ এবং ওমানে থাকেন ৬ ভাগ। সরকারের ২০১৪ সালের বিবিএস রিপোর্ট বলেছে, ওই ৮৬ লাখ প্রবাসী, যাঁদের ৬৪ ভাগ তরুণ, তাঁরা নিজেরা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা শিক্ষায় মাধ্যমিকের নিচে। তাঁরা মোট রেমিট্যান্সের মাত্র ২৫ ভাগ সরসারি কলকারখানা নির্মাণে বিনিয়োগ করেন। তাঁদের আনা ১৫ বিলিয়ন ডলারের (১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা) মধ্যে বাকি সোয়া ১১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কী করেন? টিভি, ফ্রিজ ও মোবাইলের মতো বিদেশি ভোগ্যপণ্য কেনেন, প্রকারান্তরে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ হয়ে তার অনেকটা সেই বিদেশেই চলে যায়। এই নিবন্ধের সঙ্গে প্রকাশিত লেখচিত্র দেখাচ্ছে সোয়া লাখ কোটি টাকার (১৫ বিলিয়ন ডলার) সিংহভাগ কী করে তাঁরা বাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনায় খরচা করেন। ড. বিনায়ক সেনের সঙ্গে আমরা অবশ্য একমত যে পেট্রো ডলার ভাঙিয়ে তঁারা ফুচকা খেলেও তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে খুব আত্মপ্রসাদে ভোগার কিছু নেই। শীর্ষ ১০ রেমিট্যান্স গ্রহীতার মধ্যে ভারত ও চীন আছে। পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া এবং বাংলাদেশও আছে। সুতরাং বেশি রেমিট্যান্স আয় কেবল গর্ব করার মতো কিছু নির্দেশ করে না।
নতুন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীকে আরও বললাম, আমরা মাহাথিরবাদী গণতন্ত্রের কথা শুনছি। কিন্তু বলুন সেই দিন কবে আসবে, যখন কোনো এক দেশের রাজধানীতে বসে (এই যেমন আপনি আমাকে বলছেন) তাদের কোনো এক মন্ত্রী গর্বের সঙ্গে তাদের মিডিয়াকর্মীকে বলবেন, তাঁরা প্রতিদিন বাংলাদেশে চার থেকে পাঁচ হাজার কর্মী পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন। বাংলাদেশ কবে বিদেশি শ্রমিক আমদানিকারী দেশে পরিণত হবে? কেউ কি এমন স্বপ্ন দেখেন?
স্বপ্ন নিয়ে এ পি জে আবদুল কালামের একটি অমিয় বচন দিয়ে শেষ করি: ‘যা ঘুমের মধ্যে দ্যাখো, তা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন সেটাই, যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না!’