Published in Manobkantho on Saturday, 20 June 2015.
সরকার চাইলেও উন্নয়ন কাজে গতি পাচ্ছে না
জাহাঙ্গীর আলম
সরকার চাইলেও উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে গতি পাচ্ছে না। বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প পরিচালক-পিডিরা কাজ জিইয়ে বা অসমাপ্ত রেখে দিচ্ছেন। নিচ্ছেন বেশি করে বরাদ্দ, বাড়াচ্ছেন সময়। এমপি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এলাকাতেও এর ব্যতিক্রম নেই। এতে প্রতি অর্থবছরে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। তাই উন্নয়ন কাজের গতি বাড়াতে পিডিদের বদলি বাতিল ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করারও হুমকি দেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তবুও গতি বাড়ছে না উন্নয়ন কাজে। কারণ চলতি অর্থবছরে এডিপি সংশোধন করে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এরপরও জুলাই থেকে মে পর্যন্ত গত ১১ মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে ৬৭ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাজের গতি বাড়াতে ও অপচয় কমাতে আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক মনিটরিং প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাঁশখালীর ৩৪ কিলোমিটার এবং চকোরিয়া ও পেকুয়ার ১৮ কিলোমিটার সরু সড়ককে আঞ্চলিক মহাসড়কে রূপান্তরে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। স্বল্প দৈর্ঘ্যরে রাস্তা হওয়ার পরও বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত অর্থাৎ সাড়ে ৪ বছর। ‘আনোয়ারা-বাঁশখালী-কচকোরিয়া সড়ক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ৫২ কোটি টাকা ব্যয় ধরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিÑএকনেক সভায় ২০০২-০৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদন হয়। ওই প্রকল্পের মধ্যে সাড়ে ৩০ মিটার দীর্ঘ টেটং সেতুও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন হয়নি। আবারো ব্যয় বাড়িয়ে তা ৫৮ কোটি টাকা এবং কাজের সময়সীমা ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত সংশোধিত প্রকল্প হিসেবে একনেকে অনুমোদন হয়। প্রায় ২১ কোটি টাকা খরচ করার পর ওই সেতুটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে এর প্রকল্প পরিচালক আরিফুর রহমান মানবকণ্ঠকে জানান, সময় শেষ হওয়ায় ওই অবস্থা। তবে প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়নে চেষ্টা করা হচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির মনিটরিংয়ের মতামতের ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই প্রকল্পটিতে অর্থ ব্যয়ে ঘাপলা থাকায় তা বিস্তারিত জানতে গত সোমবার কমিশনে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। অর্থ গচ্চার এটি হচ্ছে বাস্তব চিত্র।
সময় ও অর্থের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেক সভায় সব প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। তারপরও তার এলাকাতেই প্রকল্প সংশোধনের চিত্র পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, সম্পূর্ণ সরকারি অর্থ ব্যয়ে ‘কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া রেলপথ পুনর্বাসন এবং কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া নতুন রেলপথ নির্মাণ’ প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করেননি পিডি। বরং রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে আবারো গত মাসে বাড়তি সময় ৪ বছর এবং ৯২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বা ৮৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ অর্থ চেয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা-ডিপিপি পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। মন্ত্রণালয়ের সহকারী প্রধান বিবেক সরকার স্বাক্ষরিত ডিপিপিতে দেখা গেছে, প্রথমে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ১০১ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নের সময়সীমা ছিল ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় ১ম সংশোধনীতে মোট অর্থ ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নের সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০১০ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের অপচয় ও বাড়তি সময় শুধু ওই দুটি প্রকল্পের নয়। অধিকাংশ উন্নয়ন কাজের একই চিত্র। স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও তা স্বীকার করে সম্প্রতি বলেছেন, অনেক প্রকল্প পরিচালক মাত্র ৫ ভাগ কাজ জিইয়ে রেখে সংশোধনের জন্য উপস্থাপন করেন। আবার অনেক প্রকল্প পরিচালক একটি প্রকল্প শেষ না করেই আরেকটি প্রকল্প শুরু করতে চায়। এটা করতে দেয়া হবে না। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় সংশ্লিষ্ট সচিব এবং প্রকল্প পরিচালক উপস্থিত না থাকলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে আমি ডিও লেটার দেব। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করব।
চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য ১ হাজার ২৮৭টি প্রকল্পে এডিপির আকার ধরা হয় ৮০ হাজার কোটি টাকা। শুরু থেকেই সরকার এবার শতভাগ এডিপি বাস্তবায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত জানুয়ারিতে বলেছিলেন, চলতি অর্থবছরে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তা অর্জন সম্ভব হবে। কিন্তু গত ৮ মাসে এডিপি আশানুরূপ না হওয়ায় অন্য বছরের মতো আবারো উন্নয়ন বাজেট সংশোধন করেন। কিছু পিডির অনীহার কারণে শেষ পর্যন্ত চিরচেনা পথে এবারো হাঁটতে হয় সরকারকে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত গত ১১ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৫১ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা বা ৬৭ শতাংশ। মাত্র এক মাসে কাজ সম্পন্ন করতে হবে ৩৩ শতাংশ। তা কী করে সম্ভব? এ ব্যাপারে পরিকল্পনা সচিব মোহাম্মদ সফিকুল আজম মানবকণ্ঠকে বলেন, প্রতি অর্থবছরের শেষে কাজের গতি বাড়ে, তাই বাস্তবায়নের হারও বাড়ে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, সংশোধিত এডিপির শতভাগ বাস্তবায়ন না হলেও ৯৭ শতাংশ হতে পারে। এতেই আমরা সন্তুষ্ট বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও আগের অবস্থান থেকে সরে এসে এ প্রতিবেদককে ধীর গতির ব্যাপারে বলেন, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বর্ষাকাল থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তবে আমরা আগামী অর্থবছরের শুরু থেকে সতর্ক থাকব, যাতে করে শেষ প্রান্তিকে এসে বেশিরভাগ বাস্তবায়ন না হয়। আশা করছি অন্যান্য বছরের মতো এবারো এডিপি বাস্তবায়ন ১০০ ভাগের কাছাকাছি হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির রিসার্চ ফেলো ড. তোফিকুল ইসলাম খান মানবকণ্ঠকে বলেন, সরকার চাইলেও উন্নয়ন কাজে গতি পাচ্ছে না। এটা চিরাচরিত ঘটনা। তাই আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার। এতে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। থাকবে মনিটরিং ব্যবস্থা।
আইএমইডি সূত্র মতে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সব সরকারই ক্ষমতায় এসে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়নের কথা বলে। কিন্তু দীর্ঘ ৪০ বছরে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৪ বার। কোনো বছরেই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার প্রকল্প সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৫৬ শতাংশ। এর ৫ বছর পর ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে ১০৪ শতাংশ, ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন হয়। এরপর দীর্ঘ ৮ বছর পর ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে ১০১ শতাংশ এবং সর্বশেষ ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে ১১২ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়নের রেকর্ড সৃষ্টি হয়ে আছে। এরপর দুই যুগ কেটে গেছে। শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি এডিপি। এবারো সেই পথে থাকল সরকার। এতে বাড়ছে রাষ্ট্রের খরচ। একই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্পের বোঝাও বাড়ছে। গত অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে ৯৫ শতাংশ।