Published in Bonik Barta on Tuesday, 9 September 2014.
প্রত্যাশা বড় প্রাপ্তি ক্ষুদ্র
বদরুল আলম
দুই দেশের নীতিনির্ধারকরাই বিশ্বাস করেন, ভারত থেকে বিনিয়োগ না এলে প্রতিবেশী দুটি দেশের বাণিজ্যে ভারসাম্য আসবে না। পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে সে পথেই হাঁটতে হবে। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশটির উদ্যোক্তা, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এ ব্যাপারে বারবার তাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভারতীয় উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে ভালো ব্যবসা করছেন, এ খবর পেলে সারা বিশ্বের কাছেও এ বার্তা দ্রুতই পৌঁছে যাবে। তখন বিশ্বের অন্য বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো থেকেও বড় বিনিয়োগ আসতে শুরু করবে। একটা যথাযথ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে— এমনই প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ভারত থেকে তেমন কোনো পুঁজি আকর্ষণ করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ৪২ বছরে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতীয় মোট পুঞ্জীভূত বিনিয়োগের (এফডিআই স্টক) পরিমাণ মাত্র ২০ কোটি ১৫ লাখ ১০ হাজার ডলার। এফডিআই স্টকের পরিমাণ অনুযায়ী বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগে ভারতের অবস্থান ১৩তম।
বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য বলছে, কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগের অনেক আগ্রহ প্রকাশ পেলেও ভারত থেকে প্রকৃত বিনিয়োগ তেমন একটা আসেনি। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, ২০১০-১১ অর্থবছরে ভারতীয় নিবন্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৮০ লাখ ২০ হাজার ডলার। এর বিপরীতে সে বছর প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৯ কোটি ৭০ লাখ ৯৯ হাজার ডলারের বিনিয়োগ নিবন্ধন হলেও প্রকৃত বিনিয়োগ ছিল ২ কোটি ৭৮ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
তবে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ভারতীয় অনেক উদ্যোক্তাই আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ অর্থবছরে নিবন্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২১২ কোটি ৬ লাখ ৪৭ হাজার ডলার। কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৪ কোটি ২০ লাখ ৯০ হাজার ডলার। আর গত অর্থবছরে বাংলাদেশে যৌথ ও শতভাগ ভারতীয় বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে ১৬ কোটি ৯৬ লাখ ২৩ হাজার ডলার। সে অর্থবছরের ছয় মাসে ভারতের প্রকৃত বিনিয়োগ হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ১০ হাজার ডলার। অর্থাৎ বিনিয়োগ প্রস্তাব যা-ই থাকুক না কেন, প্রকৃত বিনিয়োগ ঘুরেফিরে ২ থেকে ৪ কোটি ডলারের মধ্যে ছিল।
ইন্দো বাংলা চেম্বার অব কমার্সের বিশেষ উপদেষ্টা ও সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহ্মাদ বণিক বার্তাকে এ প্রসঙ্গে বলেন, শুধু ভারত নয়, পুরো বিশ্বের অনেক দেশকেই বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণ করতে পেরেছে। তবে শুধু আকর্ষণ পর্যন্তই। বাস্তবায়নে যেতে পারেনি বেশির ভাগ। শুধু গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় অরবিন্দ বিনিয়োগ উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরে বহু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এসেছে বিনিয়োগের আগ্রহ নিয়ে; যার বেশির ভাগই পরে বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে স্টিল খাতে টাটা, আবাসন খাতে সাহারা, টেক্সটাইল খাতে অরবিন্দসহ এসেছিল এসআরএ গ্রুপ। এর মধ্যে অরবিন্দ কারখানা কাঠামো তৈরির পরও বিনিয়োগ বাস্তবায়ন করা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। সর্বশেষ টায়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিয়াট এলেও প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুতে এরই মধ্যে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে।
২০১৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিনিয়োগপ্রবাহ নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা করে বিশ্বব্যাংক। ‘ট্রেন্ডস অ্যান্ড ডিটারমিন্যান্টস অব ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক সে গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেকটি দেশে পাকিস্তান বাদে সবগুলোতেই ভারতীয় বিনিয়োগের আধিপত্য বেশি। রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানে ভারতীয় বিনিয়োগ কম হলেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সত্ত্বেও বাংলাদেশে সে তুলনায় বিনিয়োগ আসেনি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকে নেপালে বৈদেশিক বিনিয়োগপ্রবাহে ৫৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ এসেছে ভারত থেকে। একই চিত্র ভুটানেরও। উল্লিখিত সময়ে দেশটির মোট বিদেশী বিনিয়োগের ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভারতের। শ্রীলংকার ক্ষেত্রে তা ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ ও মালদ্বীপের ২৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ভারতসহ সব দেশের বিনিয়োগকারীরাই বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে আসার পর কিছু মৌলিক সেবার আশা করেন। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বাদে বাংলাদেশের বন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো বিষয়গুলোয় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ট্রেড লজিস্টিক সাপোর্ট উন্নয়নও সম্ভব হয়নি। এছাড়া বাস্তবায়ন পর্যায়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক বাধার কারণেই বিদেশী বিনিয়োগ বাস্তবায়নচিত্র সন্তোষজনক নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এফডিআই স্টকের খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারত এখন পর্যন্ত যেসব খাতে বিনিয়োগ করেছে, তার মধ্যে শীর্ষে আছে বস্ত্র ও পোশাক এবং ব্যাংকিং খাত। এ দুটি খাতে এফডিআই স্টকের পরিমাণ যথাক্রমে ৭ কোটি ৬৪ লাখ ২০ হাজার ও ৮ কোটি ৭৭ লাখ ৭ হাজার ডলার। এছাড়া সামান্য পরিমাণ বিনিয়োগ আছে খাদ্য, কৃষি ও কেমিক্যাল খাতে। কিন্তু ভারতীয় ব্যবসায়ীরা হালকা প্রকৌশল, আবাসন অবকাঠামো খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আগ্রহ নিয়ে এলেও পরে তা আর বাস্তবায়ন করেননি।
ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতসহ সব দেশের প্রকৃত বিদেশী বিনিয়োগপ্রবাহ কম হওয়ার মূল কারণ অবকাঠামো সমস্যা। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জমি— এ তিনটির সংকটেই আগ্রহ নিয়ে বিদেশীরা এলেও পরে হতাশ হয়ে ফিরে যান।
এ বিষয়ে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) প্রেসিডেন্ট সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ‘ভারতসহ সব বিনিয়োগকারীর জন্যই প্রধান সমস্যা বাংলাদেশের অবকাঠামো। তার পরই মূল বাধা হয়ে দাঁড়ায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এর পরও গত এক দশকে ভারতীয় বিনিয়োগ নিয়ে আমরা আশাবাদী। অবকাঠামো সমস্যা দূর করতে পারলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ভারতীয় বিনিয়োগ বেড়ে যাবে।’
ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রতিবেদন-২০১৩ অনুযায়ী, গত চার দশকে বাংলাদেশের মোট বিদেশী বিনিয়োগে ভারতের অবদান প্রায় ৩ শতাংশ। প্রথম অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপ ও আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলো। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিলেও বিনিয়োগপ্রবাহ তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে, দেশটির বিনিয়োগ আগ্রহ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ তেমন সফল হতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে বিনিয়োগ আসছে, তবে এর গতি আরো বাড়ানো প্রয়োজন। অবকাঠামো ঘাটতি দূর করে পরিস্থিতির পরিবর্তন করা না হলে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছা দুরূহ হয়ে পড়বে।
নিবন্ধিত ও প্রকৃত বিনিয়োগের মধ্যে তারতম্যের মূল কারণ অবকাঠামোগত সমস্যা— এমন মন্তব্য করেন বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশ ও উৎপাদনক্ষেত্র হিসেবে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের সাফল্য ভারতকে আকর্ষণ করেছে। আর দেশটির বিনিয়োগসংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় সম্ভাবনাময় সব দেশেই বিনিয়োগ বাড়িয়েছে ভারত। শুধু ভারত নয়, প্রায় সব দেশেরই নিবন্ধন ও প্রকৃত বিনিয়োগের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়।