Published in Bangladesh Pratidin on Saturday, 8 February 2014.
পরিবর্তন চ্যালেঞ্জে সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক
বিভিন্ন খাতে পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গত পাঁচ বছর যে বিষয়গুলো আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করেছিল এবার তার পরিবর্তনের দাবি সর্বস্তরে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ; আইজিডব্লিউ ও আইসিএক্সে সরকারি বকেয়া অর্থ আদায়; মন্ত্রী-এমপি-প্রভাবশালীদের লাইসেন্স ব্যবসা বন্ধ; প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় পরিবর্তন এবং বিদেশি কূটনৈতিক মিশনে নিয়োগ নিয়ে সরকারে আলোচনা চলছে। সরকার গত পাঁচ বছরের মতো এবারও একই নীতিতে চললে গভীর সংকট তৈরি হবে বলে দায়িত্বশীল মহল মনে করে।
জানা গেছে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির বিচার নিয়ে বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ দুই দফায় শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে বিতর্কিত হয়েছিল। এ কারণে অনেকে মনে করেন, এবার শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিচার হলে সরকার দায়মুক্ত হবে। অন্যদিকে, শেয়ারবাজার আবার চাঙ্গা হবে। দরকার শুধু সরকারি সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে শেয়ারবাজার ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুঁজিবাজারে কেলেঙ্ককারির সঙ্গে জড়িতদের বিচার হলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা আরও বাড়বে। কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিচার হলে পুঁজিবাজারে জবাবদিহিতা বাড়বে। পুঁজিবাজার ও অর্থনীতির স্বার্থে এই বিচার হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে বিচার করলে তা স্বাগত জানানোর মতো হবে। তবে পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনের সঙ্গে বিচারের সম্পর্ক নেই বলেও মনে করেন তিনি। ড. আবু আহমেদ আরও বলেন, আর্থিক খাতের অন্যান্য অপরাধের বিচার হলে, পুঁজিবাজারে কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদেরও বিচার হওয়া উচিত। দেশের আইন অনুযায়ী এ বিচার হলে আগামীতে অপরাধীরা আর সাহস পাবে না।
শেয়ারবাজারের মতো গত পাঁচ বছর ব্যাংকিং খাতেও সরকার বিতর্কিত ছিল। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোয় চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-নীতি ছিল না। এ কারণে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। অনিয়মে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকার পরও হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকিং কেলেঙ্কারি মোকাবিলা করতে হয়েছে। এখনো এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। তারা আশা করছে, আগের বিতর্কিত সবাইকে বিদায় করে নতুন করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, সরকারি ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগে রাজনৈতিকীকরণের ফলে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটেছে। সরকারি ব্যাংকে সর্বশেষ পরিচালক নিয়োগে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে, কিন্তু তা মোটেও টেকসই নয়। আসলে কে সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালক নিয়োগ দেয় তা পরিষ্কার নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হলেও মূলত পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক প্রভাবে আমলাতান্ত্রিকভাবে। এর পরিবর্তন করে সরকারি ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে।
ব্যাংকিং খাতের মতো টেলিযোগাযোগ খাত নিয়েও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল বিগত সরকার। গত পাঁচ বছর অবাধে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা করেছেন সরকারের প্রভাবশালীরা। এ কারণে এ খাতেও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। গত পাঁচ বছরে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন রাজিউদ্দিন রাজু ও অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। এর মধ্যে বিভিন্ন কারণে পাঁচ বছর রাজু সমালোচিত ছিলেন। অন্যদিকে, ব্যক্তিগতভাবে সৎ হওয়ার পরও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ ছিলেন সাহারা খাতুন। এখন এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তারও অনেক বিষয় প্রশ্নবিদ্ধ। এ কারণে অনেকে মনে করেন এ মন্ত্রণালয়ের প্রতি খোদ প্রধানমন্ত্রীর গভীর দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধ হবে না। এ ছাড়াও আইজিডবি্লউ ও আইসিএঙ্ েঅনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপির প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া রয়েছে। রাষ্ট্রীয় এ অর্থ ফেরত দেওয়ার কোনো লক্ষণ তাদের মধ্যে নেই। এ নিয়েও মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা আছে। এবার এ খাত নিয়েও সরকার বাস্তবমুখী অবস্থানে থাকবে বলে পর্যবেক্ষক মহল আশা করছে।
এদিকে, গত পাঁচ বছর সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিরা লাইসেন্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মন্ত্রী কিংবা সাংবিধানিক পদে বহাল থেকে তারা ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিভিশন, রেডিও, ফিশিং ট্রলারের লাইসেন্স নিয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রী কিংবা সাংবিধানিক পদে থাকার পর কেউ নিজের নামে অথবা স্ত্রী এবং পরিবারের কারও নামে সরাসরি ব্যবসা করতে পারেন না। এতে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করা হয়। অথচ গত পাঁচ বছর তা কেউ মানেননি। এ কারণে হলফনামায় নজিরবিহীন অর্থের মালিক হওয়ার হিসাব দাখিল করেছিলেন সবাই। অনেকে ধারণা করছেন, হলফনামার বাইরেও তারা বিশাল সম্পদের মালিক। এ ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব ড. আকবর আলি খান বলেন, সরকারের দায়িত্বে থাকাকালে ব্যবসা করলে প্রভাব খাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। দায়িত্বশীল ব্যক্তির নৈতিক অবস্থানও দুর্বল হয়। তিনি বলেন, হলফনামায় বিপুল পরিমাণ অর্থের অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু মন্ত্রিসভার বাইরে রাখলেই হবে না, যথাযথ তদন্ত করে অর্থের উৎস সম্পর্কে জনগণকে জানাতে হবে। না হলে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা জনগণের কাছে পৌঁছে যাবে; যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি তৈরি করবে।
দায়িত্বশীল মহলের মতে, মন্ত্রিসভায় ৩৬ জন সদস্যকে পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপদেষ্টা পদে পরিবর্তন আসেনি। এমনকি বিতর্কিত একাধিক উপদেষ্টা বহাল রয়েছেন; যা বিভিন্ন মহলের কাছে দৃষ্টিকটু হিসেবে মনে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে ব্যাপক পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখনো আশা করছে, পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। এ সরকার যত বেশি পরিবর্তন ঘটাবে এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার দিকে দৃষ্টি দেবে ততই তাদের অবস্থান সুসংহত হবে।