Published in The Daily Jugantor on Tuesday, 24 December 2013.
স্যালাইন দিয়েও দূর করা যাচ্ছে না রাজনৈতিক সংকট
শাহ আলম খান
রাজনৈতিক সংকট দূর না হওয়া পর্যন্ত অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে অর্থনীতির মুক্তি মিলছে না। এতে দেখা দিয়েছে দীর্ঘমেয়াদব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট। ইতিমধ্যেই অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় দিনকয়েক পরই পথ চলা শুরু হবে নতুন বছরের দিশেহারা অর্থনীতির। বড় ধরনের ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না এলে নতুন বছরে ক্ষমতায় আসতে চলেছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিজয়ী দল। তবে বিরাজমান রাজনৈতিক সহিংস পরিস্থিতিতে স্যালাইন পুশ করে বাঁচিয়ে রাখা অর্থনীতিকে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কোনো গ্যারান্টি মিলছে না আগামী কর্মপরিকল্পনায়।
বরং সরকারের একলা চলো নীতি ও বিরোধী পক্ষের অনমনীয় মনোভাবকে কেন্দ্র করে নতুন বছরে সম্ভাব্য সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সংকট দূর হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ অর্থনৈতিক স্থিতি নির্ভর করে রাজনৈতিক স্থিতির ওপর। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট মনে হচ্ছে সামনে আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেইন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে কথাবার্তা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক সংকট সুরাহার পথ আরও জটিল আকার ধারণ করবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যেহেতু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই অর্থনীতিও দীর্ঘ সংকটে পা রাখতে যাচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অনারারি ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বলেন, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতি মধ্যমেয়াদি সংকটে পড়ার আশংকা রয়েছে।
এদিকে বিরোধী পক্ষগুলো থেকে দাবি আদায়ে এতদিন ঢিমেতালে কর্মসূচি দেয়া হলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর লক্ষ্যে কিংবা নির্বাচন-পরবর্তী সরকারকে মোকাবেলায় বিরোধী সব পক্ষ একযোগে অসহযোগের মতো কর্মসূচিতে যাচ্ছে এমন গুঞ্জন চাউর হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।
শুধু তাই নয়, এ বিষয়ে একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সরকারকে কাবু করার একমাত্র উপায় হিসেবে সরকারবিরোধীরা আগামীতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। তাদের লক্ষ্য পরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করা। তাই যে কোনোভাবেই অর্থনীতিকে দুর্বল করতে পারে- এমন কর্মসূচিকেই আগামীতে প্রাধান্য দেয়া হতে পারে। এ অবস্থায় কর্মসূচির রূপ আরও সহিংস হয়ে উঠতে পারে। এতে বিভিন্ন অবকঠামো ধ্বংসের তাণ্ডবলীলাও আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণ নেই। যে কোনো অরাজকতা কঠোর হাতে দমনের কথাও তিনি জানান।
তবে অর্থমন্ত্রীর এ ঘোষণা কতটা বাস্তবায়ন হয় সেটি দেখার অপেক্ষা করতে নারাজ ব্যবসায়ীরা। তারা অভিযোগ করেন, আশার কথা আর শুনতে চাই না। দীর্ঘদিন ধরে যে সহিংসতা ও ধবংসাত্মক কর্মসূচির মাধ্যমে অর্থনীতির বারোটা বাজানো হয়েছে, তা প্রতিরোধে সরকারকে একরকম অসহায় ও নির্লিপ্তই দেখা গেছে। পুলিশ প্রহরায়ও রফতানিমুখী পণ্যের ট্রাক জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। মাইলকে মাইল বিস্তৃত সড়ক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সার্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা অচল করে দেয়া হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখা যাচ্ছে না। এ অচলাবস্থা এখনও চলছে।
ব্যবসায়ীরা এ পরিস্থিতির জন্য সরকারের একলা চলো নীতি ও বিরোধী দলের ছাড় না দেয়ার অনমনীয় মনোভাবকেই দায়ী করছেন। তারা দাবি করছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে মুমূর্ষু অর্থনীতিকে সুস্থ করা যাবে না।
দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়া প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ইতিমধ্যেই দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। দেশজুড়ে বিস্তৃত অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে। রফতানিতে চিড় ধরার উপক্রম। সেই সঙ্গে ভাবমূর্তি সংকটে রফতানি বাজারও হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগ একরকম থেমেই গেছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতি এই গুরুত্বপূর্ণ এসব উপাদান হারিয়ে গেলে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তিনি বলেন, রফতানি বাজার একবার হারিয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা বড় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। নষ্ট হয়ে পড়া বিস্তৃত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণও সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এই বাড়তি ব্যয় দেশের অর্থনীতিকে পিছিয়ে দেয়। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ ও বিনিয়োগ নিরাপত্তা না পেলে বিনিয়োগও আসবে না। অর্থনীতিতে এসবের অনুপস্থিতি দীর্ঘ বছর পিছিয়ে দেবে আমাদের।
সিপিডি অনারারি ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিনিয়োগ ও বাণিজ্য পরিস্থিতির ওপর গুরুত্বারোপ করে আরও বলেন, দেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রসারে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দরকার রয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় এর চেয়েও বেশি জরুরি স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি। নিরাপত্তা না পেলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন না। বিদ্যমান অবস্থায় বাংলাদেশের প্রতি বিদেশীদের আস্থা ধরে রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেইন আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে আমরা দেশের অর্থনীতিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি যেখান থেকে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি রাজনীতির দীনতায় হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে তো আগামী মাস থেকে আমাদের মিল-কারখানা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।