Published in Prothom Alo on Monday, 24 February 2014.
বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ব্যয় সামলানোর চেষ্টা
অরুণ কর্মকার
যে সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে সরকার ২০০৯ সালে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে এবং বেশি দামের বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, সে অনুযায়ী এ বছর থেকেই বিদ্যুতের দাম কমার কথা। অথচ ১ মার্চ থেকে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
মূলত, সরকার তার মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন করে অপেক্ষাকৃত কম দামের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণেই এখন আবার দাম বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম. তামিম বলেন, গত পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সাফল্য প্রধানত তরল জ্বালানিনির্ভর ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ও পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে। এই জরুরি উদ্যোগ অবশ্যই অপরিহার্য ছিল। কিন্তু এসব কেন্দ্রের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। অপেক্ষাকৃত কম দামের বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় এই কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। তাই দামও বাড়াতে হচ্ছে। সার্বিকভাবে এর ফল শুভ হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
২০০৯ সালের ওই পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্টভাবে হিসাব করে দেখানো হয়েছিল, তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ও পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র করায় বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে ২০১২-১৩ সালে।
এরপর গ্যাস ও কয়লাভিত্তিকে কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে চালু হতে থাকলে ২০১৩-১৪ সাল থেকে বিদ্যুতের দাম কমবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তৎকালীন চেয়ারম্যান এস এম আলমগীর কবির হিসাব করে দেখিয়েছিলেন, ২০১৩-১৪ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় হবে চার টাকা ৩২ পয়সা। এর পরের বছর তা আরও কমে হবে তিন টাকা ৯৮ পয়সা।
অথচ পিডিবির সর্বশেষ অভ্যন্তরীণ প্রাক্কলন অনুযায়ী আগামী বছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে হবে ছয় টাকা ২৭ পয়সা। সরকার চাইছে, এখন এক দফা দাম বাড়িয়ে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য উৎপাদন ব্যয়ের কাছাকাছি নিয়ে যেতে, যাতে এই খাতে ভর্তুকি ন্যূনতম পর্যায়ে কামিয়ে আনা যায়।
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কর্মকর্তারা জানান, গত সপ্তাহে পাঁচটি বিতরণ কোম্পানি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আগামী ৪, ৫ ও ৬ মার্চ ওই প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ১ মার্চ থেকে দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে। বিতরণ কোম্পানিগুলো গড়ে ১৫ শতাংশেরও বেশি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ এই প্রথম। তবে ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আড়াই বছরে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে পাঁচবার করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে মোট ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ দাম বেড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম হয়েছে এখন পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা। আর প্রতি ইউনিটের উৎপাদন মূল্য এখন ছয় টাকা ২২ পয়সার মতো।
দাম বাড়ানোর অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। তাই রাজস্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দাম বাড়ানো অপরিহার্য নয়। তা ছাড়া প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে, বিনিয়োগ নেই। উৎপাদন পরিস্থিতিও দুর্বল। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে অর্থনীতি একটা বাড়তি চাপের মুখে পড়বে।
দেশে মূল্যস্ফীতি এখন ৮ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াবে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়বে। কৃষিকে এই দাম বৃদ্ধির আওতায় রাখা হলে সেখানেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এসব বিষয় সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ না করে শুধু ভর্তুকি সুষমকরণের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফল ভালো হওয়ার কথা নয় বলেও মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।