Published in Manabzamin on Saturday, 8 February 2014.
১৪ ভাগ ভোটারই তুরুপের তাস
বিশেষ প্রতিনিধি
নির্বাচনী জরিপ নিয়ে বিতর্ক বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। অতীতে সব নির্বাচনের আগেই জরিপ হয়েছে। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এইসব জরিপের ফলাফল সত্য হয়নি। যদিও উন্নত বিশ্বে জরিপ সত্য হওয়ার রেকর্ডই বেশি। বাংলাদেশে সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) জরিপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা এ জরিপের ফলাফলকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে পর্যবেক্ষকরা দেখছেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এ জরিপের সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ কমই হয়েছে। ১১ থেকে ১৫ই জানুয়ারি দেশের সাত বিভাগের ৩৯টি জেলায় এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। ১৮ অথবা তার চেয়ে বেশি বয়সের দেড় হাজার ভোটার জরিপে অংশ নেন। বহুস্তর ভিত্তিতে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে এ জরিপ চালানো হয়। জরিপের ফলাফলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়েছে দু’টি প্রশ্ন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যদি ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করতো তাহলে আপনি কাকে ভোট দিতেন? জরিপে এ প্রশ্নের উত্তরে ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগ এবং ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ বিএনপিকে ভোট দেয়ার কথা জানান। তবে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ তারা কোন দলকে ভোট দিবেন তা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানান। ২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ এ প্রশ্নের উত্তর জানেন না অথবা বলতে চান না। এ প্রশ্নের উত্তরে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ জাতীয় পার্টি এবং ১ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেয়ার কথা জানিয়েছেন। যদিও নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলটির নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য এক টিভি অনুষ্ঠানে বলেন, সাধারণত যারা তথ্য প্রকাশ করেন না তারা বিরোধী দলকে ভোট দিয়ে থাকেন। জরিপে আরেকটি আলোচিত প্রশ্ন ছিল, এখন ভোট হলে আপনি কোন দলকে ভোট দিবেন? উত্তরে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ আওয়ামী লীগ এবং ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ বিএনপি’র পক্ষে ভোট দেয়ার কথা বলেন। একই সঙ্গে ৩ দশমিক ৭ ভাগ জাতীয় পার্টি এবং ১ দশমিত ৩ ভাগ জামায়াতকে ভোট দেয়ার কথা জানায়। তবে এ প্রশ্নের উত্তরেরও সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে ১৩ দশমিক ৯ ভাগ ভোটার কোন দলকে ভোট দিবেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতার কথা জানান। বাংলাদেশ ইন্সটিউিট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজ এর প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে ডিআই-এর জরিপ খণ্ডিতভাবে প্রকাশ হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, সব নির্বাচনেই জয়-পরাজয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে সুইং ভোট। এ জরিপে দেখা গেছে ১৪ ভাগ উত্তরদাতা কোন দলকে ভোট দিবেন তা প্রকাশ করেননি। এ সুইং (ভাসমান) ভোটের বড় অংশ যদি বিএনপি’র পক্ষে যায়, একই সঙ্গে জামায়াত এবং অন্য ইসলামপন্থিদের ভোট বিএনপি’র বাক্সে জমা হলে বিএনপি’র নির্বাচনে জয় লাভের বড় সম্ভাবনা ছিল। পর্যবেক্ষকরা দেখছেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনে হলে সিদ্ধান্ত প্রকাশ না করা অথবা সিন্ধান্ত না নেয়া ১৪ ভাগ ভোটারই হবেন তুরুপের তাস। কারণ জরিপের ফল অনুযায়ী কোন ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ভোটের ব্যবধান ৭ ভাগের বেশি নয়। এক্ষেত্রে ১৪ ভাগ সুইং ভোটের বেশির ভাগ অংশ যে দলের দিকে ঝুঁকবে নির্বাচনে নিশ্চিতভাবে সে দলই জয়ী হবে।
ডিআইয়ের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও সংস্কারবিষয়ক (ডিপিআর) কর্মসূচির অংশ হিসেবে নিয়েলসন বাংলাদেশের সহায়তায় জরিপটি পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (ইউএসএআইডি) ও বৃটেনের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (ইউকেএইড) অর্থায়নে পাঁচ বছর মেয়াদি ডিপিআর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, নতুন নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের পক্ষে মত দিয়েছেন ৫৭ ভাগ মানুষ। সংলাপের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন ২৪ ভাগ উত্তরদাতা। দেশ কি সঠিক পথে চলছে, নাকি ভুল পথে চলছে? এ প্রশ্নের জবাবে ৬৯ শতাংশের মত হচ্ছে দেশ ভুল পথে চলছে। অন্যদিকে, ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন দেশ সঠিক পথে চলছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৭ শতাংশ জানান, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে তারা ভোট দেননি। ২৩ শতাংশ এ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। ভোট না দেয়াদের ৬৬ শতাংশই জানান, তাদের এলাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় তাদের ভোট দেয়ার সুযোগই ছিল না। ৫৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সরকারের মেয়াদ সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত। জরিপে ৫৯ শতাংশ মানুষ মত দিয়েছেন, পাঁচ বছরের আগেই দেশে আরেকটি নির্বাচন হওয়া উচিত। এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন ২৫ শতাংশ উত্তরদাতা। আরেকটি নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি’র আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা। তবে আন্দোলনের পরিবর্তে বিএনপি’র সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসা উচিত বলে মনে করেন ৫২ শতাংশ মানুষ। ৫৫ শতাংশ মানুষ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে একটি প্রহসন মনে করেন। অন্যদিকে, ৪১ শতাংশ মানুষ মনে করেন এ নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য বা প্রয়োজনীয় কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৮ ভাগ উত্তরদাতা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে। ৩৪ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন ৫ই জানুয়ারি বিএনপি’র নির্বাচন বয়কট সফল হয়েছে। অন্যদিকে, ৫২ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন এক্ষেত্রে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। ৩২ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন বিএনপি’র উচিত জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। ৪৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন বিএনপি কার সঙ্গে জোট করবে তা কোন বিষয় নয়। ৫০ ভাগ উত্তরদাতার মতে, জনগণ নতুন সরকারকে প্রত্যাখ্যান করবে। অন্যদিকে, ৩৮ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন জনগণ নতুন সরকারকে গ্রহণ করবে।