Dr Debapriya Bhattacharya on Political Business Cycle in Bangladesh, published in the Daily Bartoman on Sunday, 27 October 2013.
চলমান অস্থিরতায় অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সংশয়
চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। থমকে গেছে অর্থনীতির অগ্রগতি। হরতাল, ভাঙচুরসহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সব ধরনের অর্থনৈতিক সূচকের নেতিবাচক প্রবণতা তৈরি হয়েছে। মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং পোশাক, চামড়া খাতসহ বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সংশয় তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, রফতানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের প্রতিবেদক রুমানা রাখি।
ড. আকবর আলি খান
চলমান পরিস্থিতি সর্ম্পকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান বর্তমানকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নতুন কিছু না। তবে এখন যা হচ্ছে তাতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়িক মহল। রাজনীতিক অস্থিতিশীলতা আরও বাড়ে যখন কোনো দল হরতাল ডাকে। তিনি বলেন, হরতালে মূলত তিনটি সমস্যায় পড়ে দেশ ও ব্যবসায়ীরা। প্রথমত, উত্পাদন ও প্রবৃদ্ধি কমে যায়। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে ভয় পায়, ফলে ব্যবসায়িক ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়। তৃতীয়ত, যারা দিন আনে দিন খায় তাদের দৈনিক উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। এতে সামাজিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এর থেকে সমাধানের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, প্রধান দুই দলকে রাজনৈতিক সংঘাতে না গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে করতে হবে। না হলে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ব্যবসায়িকভাবে আমাদের অবস্থান যেখানে হওয়ার কথা ছিল তা থেকে আমরা অনেক নিচে নেমে যাব। সব মিলিয়ে শেষ অর্থবছরে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিক ব্যবসায়িক চক্রে প্রবেশ করছে। ব্যবসায়িকরা ব্যবসা করতে ভয় পাচ্ছে। ফলে এই নির্বাচনের বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে, বৃদ্ধি পাবে রাজস্ব ব্যয়। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হলেও তা হবে ৬ শতাংশের কম। এর আগের তিনটি নির্বাচনে বছরেই লক্ষ্যমাত্রা আগের বছরের তুলনায় কম ছিল। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খরচ বাড়ানোর ফলে নির্বাচনের বছর রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। কমে যাবে সরকারি বিনিয়োগ ও কর আদায়ের হার। গতকাল তিনি বর্তমানকে বলেন, হরতালে এমনিতেই স্বাভাবিক ব্যবসা করা সম্ভব হয় না। একের পর এক রাজনৈতিক সংঘাতের পর হরতাল ব্যবসায়িক মহলকে মুখ থুবরে ফেলবে। এই ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে ব্যবসায়ীদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
সেলিম ওসমান
গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর সভাপতি সেলিম ওসমান বলেন, ‘সরকারি দল থেকে সমঝোতার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তা বিরোধীদলের মানা উচিত। প্রতি পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনে সরকারের কাঠামোর যেমন পরিবর্তন হয়, ঠিক তেমনি পরিবর্তন নেমে আসে ব্যবসায়িক অবস্থারও। তাই দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দরকার। রাজনৈতিক হানাহানিতে কোনো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব না।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপর প্রভাব পড়বে বলে উল্লেখ করে সেলিম ওসমান বলেন, রফতানি আয়ের বেশিরভাগই আসে পোশাকখাত থেকে। কিন্তু বর্তমান চলমান পরিস্থিতিতে অনেক বিদেশি ক্রেতাই বাংলাদেশে অর্ডার দিতে ভয় পাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে রফতানি আয়। মালিক শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে দ্বন্দ্ব তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারবে। কিন্তু কারখানাগুলোই যদি ঠিকভাবে চলতে না পারে তা হলে মালিক ও শ্রমিকের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েও কোনো সমাধান করা যাবে না। তাই হরতালকে বন্ধ করতে রাজনৈতিরক সমঝোতার দরকার।
আবদুস সালাম মুর্শেদী
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, হরতালের ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে এর আগে আমরা অনেকবার প্রধান রাজনীতিক দলগুলোর কাছে তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু তার কোনো সমাধান তারা করেনি। বর্তমানে পোশাক খাতে যে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে তাতে ক্ষণে ক্ষণে হরতাল উত্পাদন ব্যাহত করছে। বিপাকে পরছে ব্যবসায়ীরা। বাতিল হচ্ছে শিপমেন্ট। রাজনৈতিক এ রকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে এক সময় এ দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেবে।
শাহীন আহমেদ
বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, ঈদের পর চামড়ার বাজার এখনও অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে। তারপর যদি রাজনৈতিক কারণে আবার হরতাল ডাকা হয় তাহলে চামড়া ব্যবসায়ীরা বিরাট এক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তিনি জানান, অস্থিতিশীলতার কারণে ঢাকার বাইরে থেকে চামড়া সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেখানে ঈদের পর প্রায় ৫০ শতাংশ চামড়া কারখানায় আসার কথা, এখন পর্যন্ত তা এসেছে ২০ শতাংশ। তিনি বলেন, এ রকম চলতে থাকলে এবারের অর্থবছরে চামড়ায় যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন করা সম্ভব হবে না ব্যবসায়ীদের। তিনি আরও বলেন, হরতাল হলে ব্যবসায়ীরা পরিবহন সঙ্কটের কারণে চামড়া নিয়ে ঢাকায় আসতে পারবে না। ফলে নষ্ট হবে অনেক চামড়া। রাজনৈতিক ক্ষতির কারণে চামড়া ব্যবসায়ীরা যে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে তা কাটিয়ে উঠতে সামনের কোরবানি ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
আবদুল আউয়াল মিন্টু
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সরকারকে আরও স্পষ্ট হতে হবে। তা না হলে রাজনীতির এ লড়াইয়ের সমাধান পাওয়া যাবে না। সম্ভব হবে না লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা। বর্তমানের রাজনৈতিক অবস্থার প্রভাব এরই মধ্যে অর্থনীতিতে পরা শুরু করেছে। যেখানে গত বছর অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ সেখানে বর্তমানে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। গত অর্থবছরে বেসরকারিখাতে বিনিয়োগ ছিল ২০ দশমিক ১ শতাংশ এখন তা দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশে। তিনি বলেন, তারপর যদি আবার হরতাল হয় তাহলে মুখ থুবড়ে পরবে আমাদের অর্থনীতি। দেশের ও অর্থনীতির স্বার্থে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই।