Published in Bangladesh Pratidin on Thursday, 6 February 2014.
শঙ্কা-স্বস্তির ধারায় অর্থনীতি
রুহুল আমিন রাসেল
রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেই শঙ্কাকে সঙ্গী করে স্বস্তির ধারায় ফিরছে দেশের অর্থনীতি। দশম সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে থেমেছে রাজনৈতিক সংঘাত, সংঘর্ষ ও সহিংসতা। রাজনৈতিক সংকট-অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এখন শান্ত বাংলাদেশ। গ্রাম-নগর-বন্দরে ফিরেছে নতুন উদ্যমে কর্মচঞ্চলতা। গতি ফিরেছে শিল্প-কারখানার উৎপাদন যন্ত্রে। কিছু দিন আগেও যারা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে অস্বস্তির আগুনে পুড়েছেন, তারাও এখন নতুন করে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন বলে মনে করেন অর্থনীতির পর্যবেক্ষক, বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নতুন সরকারের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান সরকারের কাছ থেকে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া আশা করা যেতে পারে। একটি হলো বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য উগ্র নীতি অনুসরণ করতে পারে। আরেকটি হলো সরকার পরিচালনা করেও ভব্যিষতে যাতে একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যায়, সে জন্য আলাপ-আলোচনা করা এবং একটি সুষ্ঠু সমাধান করা। তার মতে, কয়েক বছর ধরে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে বেশকিছু আশাপ্রদ ঘটনার উন্মোচন দেখা যাচ্ছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মতো। আমাদের বহির্বাণিজ্যের যে স্থিতি, তাও ওপরের দিকে ধাবমান। সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলো ওপরের দিকে উঠছিল। তবে সম্প্রতি যেসব ঘটনা দেখা দিয়েছে, এতে ওই সব সূচকে অবনতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বেড়েছে। এ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে নিতে যত বাধাই আসুক তা দূর করবে সরকার। সবার আগে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির স্বার্থ এবং অগ্রগতিই আমার কাছে বিবেচ্য বিষয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আইএমএফের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
তবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন নাকচ করে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, আগামীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। বিভিন্ন কারণে এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঊধর্্বগামী রয়েছে। আমরা খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব রকমের পদক্ষেপ নেব। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিঙ্ ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, সরকারের সামনে কয়েক ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিস্তৃত। সামাজিক চ্যালেঞ্জের প্রথমেই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যত দ্রুত স্বাভাবিক পর্যায়ে আনা। জনআস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যও দুর্নীতি দমন করা জরুরি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিনিয়োগ বাড়ানো নতুন সরকারের জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে সব কিছুই নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। চলতি বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। যেহেতু আয় কমছে, ব্যয়ও কমাতে হবে। কিন্তু তা কীভাবে হবে, কোন খাত থেকে নিয়ে কোন খাতে দেওয়া হবে; কীভাবে অগ্রাধিকার ঠিক করা হবে সেটাই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ বলে তিনি মনে করেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছু অশনিসংকেত যেমন রয়েছে, তেমনি সরকারের হাতে কিছু সুবিধাও আছে। তিনি বলেন, আপাতত দেশে শান্তি পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এদিকে, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৩-১৪’ শিরোনামে সিপিডি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জনপ্রত্যাশা ও অর্থনীতির শক্তির ভিত্তিতে উচ্চপ্রবৃদ্ধির যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা হারিয়ে গেছে। উচ্চপ্রবৃদ্ধির সে সম্ভাবনা ফিরিয়ে আনা সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রাখতে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বাজেটে সরকারের আয়-ব্যয়ের কাঠামো দ্রুততা ও বাস্তবতার ভিত্তিতে পুনর্নির্ধারণ করা, বোরো চাষ ও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহায়তা, রপ্তানিমুখী শিল্পসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন খাতে সহায়তা এবং বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে নীতি অনিশ্চয়তা দূর করা। সিপিডির মতে, বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য নীতি অনিশ্চয়তা দূর করতে হলে রাজনৈতিক, সামাজিক সমঝোতা প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো নীতি গ্রহণ করা হলে তার বাস্তবায়ন নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা থেকে যায়। সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটবে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, এর মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ খাতে ১৬ হাজার ৬৮৯ কোটি, কৃষি ও কৃষিজাত শিল্প খাতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, রপ্তানিমুখী বস্ত্রশিল্পে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি ও পর্যটন খাতে ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ বলেন, সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। তবে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সরকার কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা-ই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো বলছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চা হচ্ছে না। তারা সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এ অবস্থায় জিএসপি নিশ্চয়তা পেতে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করতে হবে সরকারকে। একই সঙ্গে সরকার যে জনগণের রায় নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে, তাও বিদেশি দেশগুলোর কাছে প্রমাণ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও মানবাধিকার পরিস্থিতি শান্ত করতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশিরা যেন বোঝে সরকার একতরফা কাজ করছে না।