Published in প্রথম আলো on Tuesday, 8 March 2016
বিবিএসের ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপ
কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে
মানসুরা হোসাইন
দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ না বেড়ে বরং কমছে। বাংলা–দেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশ। তবে ২০১৩ সালের জরিপে তা নেমে এসেছে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশে। তবে শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার পরও শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কেন কমছে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি।
গত বছরের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপটি তৈরি করা হয় ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৪ জেলা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে। এই জরিপ বলছে, দেশের পুরুষ জনগোষ্ঠীর ৮১ দশমিক ৭ শতাংশ শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর নারীদের মধ্যে এ হার সাড়ে ৩৩ শতাংশ। ২০০২-২০০৩ সালের জরিপে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ২৬ দশমিক ১ শতাংশ। ২০০৫-২০০৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১০ সালে তা ৩৬ শতাংশে পৌঁছে যায়। কিন্তু এরপর তা না বেড়ে কমে গেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে, তবে এই হ্রাস এখন পর্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। তবে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
রুশিদান ইসলাম রহমানের মতে, আগের কয়েক বছরে দেশে যে হারে কর্মসংস্থান হয়েছিল, তা কিছুটা কমে গেছে। মাইক্রোফিন্যান্স, পোশাকশিল্প খাতে আগে যে হারে নারীরা কাজে যোগ দিতেন, তা-ও কিছুটা কমেছে। হয়তো বেশ কিছু মেয়ে পড়াশোনা করছে বলে কর্মক্ষেত্রে আসছে না।
এ বিষয়ে জাতিসংঘের সিডও (নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ) কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খান বলেন, ‘উন্নত টেকনোলজির ব্যবহারে অদক্ষ কর্মীরা শ্রমবাজার থেকে ঝরে যাচ্ছে। এ প্রবণতা বিশ্বব্যাপী। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি আছে। এ ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে শ্রমবাজারে প্রবেশের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাবে শ্রমবাজারে ঢোকার ক্ষেত্রে নারীর সুযোগ আরও কমে যাবে এবং কমে যাচ্ছে।’
১৫ এবং ১৫ বছরের বেশি বয়সী ৫১ শতাংশ নারী জরিপটিতে অংশ নেয়। নারীদের ১০ জনের মধ্যে ৭ জনেরই বয়স ছিল ১৫ বছরের বেশি। গ্রামীণ এলাকার প্রায় ৯৫ শতাংশ নারীই অপ্রাতিষ্ঠানিক (ইনফরমাল) কাজের সঙ্গে যুক্ত। বেকার নারীর সংখ্যা ছিল ১ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা পুরুষের চেয়ে বেশি। নারীদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জনই ছিল পারিবারিক শ্রমিক।এদের বেশির ভাগই অবৈতনিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। কৃষি, কুটিরশিল্পসহ এ ধরনের কাজের সঙ্গেই নারীরা বেশি যুক্ত। প্রধান নির্বাহী বা অন্যান্য উঁচু পদেও নারীর অংশগ্রহণ ছিল কম।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, কর্মজীবী নারীর আবাসন, যাতায়াতের সুব্যবস্থা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রশিক্ষণ, সন্তান লালনপালনের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং নজর না বাড়ালে কর্মক্ষেত্রে নারীদের ধরে রাখা সম্ভব হবে না। প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে টিকে থাকতে হলে নারীর দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
বিবিএসের জরিপ বলছে, শ্রমবাজারে অংশ নেওয়া ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যেও নারীর সংখ্যা ছিল বেশি (৫১ শতাংশ)। ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ স্কুলে গেলেও ৩৩ শতাংশ কখনোই স্কুলে যায়নি।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, অনেকেই বলতে চাচ্ছে, নারীরা বেশি শিক্ষিত হচ্ছে বলে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। এ ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। নারীরা শিক্ষিত হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উঁচু পদে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ত। কিন্তু সে চিত্রও দৃশ্যমান নয়। এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কোনো ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা ছাড়া নারীদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়োগ দিলে পরিবার বা স্বামী ওই পরিবেশে নারীকে চাকরি করতে দিচ্ছেন না। শিক্ষিত, যোগ্য হওয়ার পরেও তাঁরা কাজ করতে পারছেন না। বাল্যবিবাহের ফলেও মেয়েদের একটি অংশ শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ছে। বিষয়গুলো আরও খতিয়ে দেখতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে গবেষণা করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, যে কারণেই নারীর অংশগ্রহণ কমুক না কেন, দেশের বিশাল জনসংখ্যা নারীকে উৎপাদনব্যবস্থার বাইরে রেখে উন্নতি করা সম্ভব নয়।
শ্রমসচিব মিকাইল শিপার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিবিএসের জরিপের তথ্য সম্পর্কে আমরা অবগত। তবে কী কারণে নারীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তা সেভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।’