মোঃ মোজাহিদুল ইসলাম নয়ন
উন্নয়ন কর্মী
E-mail: md.mozahidul.islam@heks-eper.org
রূপালী পাহান, বাচ্চু পাহান, যতীন পাহান, শংকরী পাহান এখনও বাইরের মানুষের সাথে সেভাবে কথা বলতে চায় না। কারণটা সাধারণ অর্থে হয়তো সংকোচ। কিন্তু শুধুই কী সংকোচ? না। আমি যখন জানতে চাইলাম তখন তারা বললো- তারা অভ্যস্ত নয়। তাদের এলাকায় বাইরের মানুষ খুব বেশী একটা যায় না। যারা যায় তারা মূলত মৌসুমী কারবারের জন্য। যেমন- ভোটের সময়গুলোতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য প্রার্থীরা ভোট চাইতে যায়। ভোট শেষ হলে আর ওমুখো হয় না। পাহান পাড়া নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার উপর-পূর্বে অবস্থিত একটি গ্রাম। এটি এনায়েতপুর ইউনিয়নে পড়েছে যেখানে ৭৫টি আদিবাসী পরিবারের বাস। তারা সবাই পাহান সম্প্রদায়ের। তবে কিছু কিছু ওঁড়াও পরিবারও রয়েছে।
এই গ্রামের প্রতিটি পরিবার এখনও দরিদ্রসীমার নীচে রয়েছে। একটি মানুষের বা পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা দেখার যতগুলো সূচক রয়েছে তার প্রতিটিতেই তারা পিছিয়ে রয়েছে। তাদের বাড়ি-ঘর কাঁচা। সামান্য খড়-ছাউনি দিয়ে অশক্ত অবস্থায় রয়েছে। বাড়িঘরগুলো অপরিসর এবং যে কোন
ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহজেই বিপদাপন্ন হবার আশংকা রয়েছে। এলাকার সাধারণ অবস্থা, রাস্তা-ঘাট একেবারেই যাচ্ছেতাই। সামান্য কিছু জমির উপরে এতোগুলো পরিবার যেনো গ্রামের মধ্যে বস্তিসম বসবাস! বাড়ি-ঘর ঘিঞ্চি হওয়ার কারণে সার্বিক পরিবেশ নোংড়া আবর্জনায় পরিপূর্ণ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গরুর গোবর, খড়-বিছালি দিয়ে যৎসামান্য ফাঁকা জায়গাগুলো অবিন্যস্ত।
সুপেয় পানি এমনিতেই বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি অন্যতম সমস্যার নাম। সারাবছর পানির জন্য অত্র অঞ্চলের মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয় বিশেষ করে যাদের সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা নেই তাদের দূর্ভোগ চরমে পৌঁছে। এরকম একটি বাস্তবতায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন রীতিমতো সঙ্গীন! এই পাহান পাড়াতে ৭৫টি পরিবারের জন্য রয়েছে মাত্র ৭টি টিউবওয়েল! যা-ও আবার সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত। তারা এতো দরিদ্র যে কেউই ব্যক্তিগত উদ্যোগে নলকুপ বসানোর সাধ্য দেখাতে পারেনি। যখন কথা হচ্ছিল—তারা বললো এই অবস্থা এখন অনেক ভালো। আগে মাত্র একটি নলকূপ ছিল যেখানে খাবার পানি সংগ্রহের জন্য ভোররাত থেকে সারি বেধে থাকতে হতো গ্রামের মানুষকে।
সেনিটেশন ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। এখন পর্যন্ত মাত্র অর্ধেক পরিবারে রয়েছে পাকা পায়খানা। রিং আর স্ল্যাব দিয়ে বসানো সবগুলো টয়লেট ঠিক স্বাস্থ্যসম্মতও নয়। আর বাকী পরিবারগুলো এখনও খোলা আকাশে মলত্যাগ করতে বাধ্য হয়। খোলা জায়গায় মলত্যাগ করার কারণে যে সকল পরিবারে পাকা টয়লেট রয়েছে তারাও ঠিক বেনিফিটেট হতে পারছে না। ফলে একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের দুষ্টচক্রে তারা আবর্তিত হচ্ছে। এখন যেটুকু উন্নতি এক্ষেত্রে হয়েছে তা বিগত দ্ইু-তিন বছর আগেও ছিল না। কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন কিছু শর্তে এগুলো করে দিচ্ছে যেখানে খানা প্রতি ২০০০ টাকা কনট্রিবিউট করতে হচ্ছে। একবার ভাবুন-ঐসকল দরিদ্র মানুষের জন্য ২০০০ টাকা রীতিমতো কঠিন একটি অঙ্কের নাম। এখনও প্রায় অর্ধেক সংখ্যক পরিবার ঐ টাকা কনট্রিবিউট করার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি!
সমতলের আদিবাসীদের জীবন কৃষি নির্ভর। তারা ক্ষেতে-খামারে ফসল ফলিয়ে, অন্যের জমিতে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পাহান পাড়ার প্রায় প্রতিটি খানা কৃষিভিত্তিক শ্রমের উপরই তাদের জীবন নির্বাহ করে। আর এর থেকে যে আয় হয় তাও নিতান্তই নগণ্য। তারা জনপ্রতি পুরুষ হলে পায় ২৫০-৩০০ টাকা আর নারী হলে পায় সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। এখানে নারীদের কম পারিশ্রমিক হওয়ার কারণ নারীরা ঘর-গেরস্থালী কাজ শেষ করে ক্ষেতে সকাল সকাল যেতে পারে না। আর এই আয়ও প্রায় মৌসুমী। বদলে যাওয়া কৃষি ব্যবস্থা, সনাতনী আবাদী ব্যবস্থার জায়গায় খামারি বা বাগান নির্ভর কৃষিতে রূপান্তরের ফলে অনেকেই আর সারাবছর কাজ পায় না। বিশেষ করে শ্রমঘণ কাজ যেমন রোপা লাগানো, ধান কাটা ও মাড়াই ছাড়া বাকী খামারী কাজ কিন্তু মৌসুমী। ফলে এটিও কৃষিনির্ভর আদিবাসী মানুষের জন্য আর একটি নতুন দুর্ভাবনা। কৃষি ছাড়া আর তেমন কোনও আয়ের সুযোগ না থাকায় তারা আয় দারিদ্রতার চরমে পৌঁচেছে। পাহান পাড়ায় মাত্র ২টি পরিবার পাওয়া গেলো যারা কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি রিকসা-ভ্যান চালিয়ে আয় করতে পারে।
আয় যখন কমে যায় বা বিকল্প আয়ের সুযোগ থাকে না তখন তার প্রভাব অনেক কিছুর উপরে পড়তে থাকে। আয় কমে আসলে তারা সঠিক পরিমান ও মানের খাবার কিনতে পারে না। তাদের শরীরে পুষ্টির অভাব দেখা দেয়, তাদের অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে যায়। পয়সার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারে না। এছাড়া বাড়তি আয় না থাকার কারণে তারা শিক্ষা ও অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজে তাদের কোনও বিনিয়োগও করতে পারে না। ফলে তাদের সন্তানদের শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ার হার অনেক বেশী। কন্যা সন্তানদের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব হলো- বাল্যবিবাহ। এছাড়া আয় কম হওয়ার কারণে তারা যেহেতু শিক্ষা-দীক্ষায়, স্বাস্থ্যে, সচেতনতায় পিছিয়ে থাকে যা তার জন্য এক অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা তৈরী করে। তারা সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে পিছিয়ে পড়ে। তারা সমাজের আর দশজনের মতো একজন নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সংকোচ বোধ করে। আজ বাংলাদেশে সমতলের আদিবাসীদের অবস্থা ঐ পাহান পাড়ার প্রতিটি মানুষের মতো, আলাদা কিছু নয়।
বলা হচ্ছে স্বাধীনতার সময় মাত্র ১০০ ডলার মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ২০০০ ডলারের কাছাকাছি -সেখানে উন্নয়ন তো হচ্ছেই। শিক্ষার হার বেড়েছে, স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ তথা স্বাস্থ্য অবকাঠামো মানুষের দ্বোরগোড়ায়, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার, বিনামূল্যে শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা জাল তৈরী করা হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু এতসব অর্থনীতির অঙ্ক কী আদিবাসীদের জীবনে তেমন অর্থ বহন করে? উন্নয়নের এই গড় হিসাব কী পাহান পাড়ার মানুষের জন্য অধিকারভিত্তিক উন্নয়নের গ্যারান্টি দেয়? এতো এতো উন্নয়ন কী তাদেরকে মানুষ হিসেবে আর দশজনের সমান কাতারে আনতে পারছে? এক কথায় উত্তর হলো-না। কারণ যে উন্নয়ন অবকাঠমো এবং সংস্কৃতি তৈরী হয়েছে তা পুঁজিবাদী অর্থনীতি। যার মোদ্দা কথা হলো-তেলা মাথায় তেল দেয়া। যার যতো আছে তার ততো হবে। সমাজে বৈষম্য বাড়বে, তথাকথিত ধনীক গোষ্ঠী টাকা দিয়ে সবকিছু কিনতে পারবে। তারা টাকার জোরে ধরাকে সরা জ্ঞান করবে।
আদতে হচ্ছেও তাই। আজ চুঁইয়ে পড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঐ পাহান পাড়া গ্রামে পৌঁছেনি। তারা অবকাঠমোগত সুবিধা পায়নি, তারা পায়নি আয়ের সুযোগ, তারা এখনও সামান্য দুমুঠো ভাতের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়। তাদের কাছে জীবনের মানে এখনও হাড় খাটানো পরিশ্রমে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। তারা সংবিধানের আলোকে একজন নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ভোগ করার কথা চিন্তায়ও আনতে পারে না। তাই আমরা যখন তাদের জীবনের গল্প বলি বা শুনি তখন মনে হয়-উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে পাহান পাড়া সত্যিই অনেক দূর!