Published in
on Wednesday 15 May 2019
আর্থিক খাত একটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে, যার কারণে অনেক সময় এ খাতকে অর্থনীতির নার্ভ-সেন্টার বলা হয়। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ব্যাংকিং খাতের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ এসব দেশে আর্থিক খাত মূলত ব্যাংকনির্ভর। ব্যাংকিং খাতের দক্ষ ব্যবস্থাপনার ওপর যেমন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল, তেমনি নির্ভরশীল ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, ভোগ ও বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কর্মচাঞ্চল্য। নীতিনির্ধারকরা তাই সদা সতর্ক থাকেন, যাতে ব্যাংকিং খাত নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে, অর্থনীতিতে সঞ্চয় আহরণ ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে যথাযথ অবদান রাখতে সক্ষম হয় এবং এ খাতে যাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন বজায় থাকে। এ কথা স্মর্তব্য, বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নে দেশের ব্যাংকিং খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে; এ কথাটি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক উভয়ের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের প্রত্যাশিত ভূমিকা একটি দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন কোন পর্যায়ে আছে, তার সঙ্গে নিকটভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ এখন একটি দ্বৈত উত্তরণের পর্যায় অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে; স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য বিবেচিত হয়েছে। এর সঙ্গে আরও যোগ করা যেতে পারে, বর্তমান সময় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের সময়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে এবং এই ত্রিবিধ বিবেচনাকে সামনে রেখে ব্যাংকিং খাতকে আগামীর দায়িত্ব পালন করতে হবে। একটি দক্ষ ব্যাংকিং খাতের তাই প্রয়োজন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এবং এমন একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়, যেখানে উন্নয়ন প্রক্রিয়া হবে জনকল্যাণমুখী এবং বণ্টন প্রক্রিয়া হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত কি এ দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত? বাংলাদেশের উন্নয়ন পথযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যেগুলো মোকাবিলা করতে না পারলে আগামীর যাত্রা ব্যাহত হবে, উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক অভিঘাত বাংলাদেশের অর্জনকে হুমকির সম্মুখীন করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যে পর্যায়ে আছে, তা চিন্তাকে অতিক্রম করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু পদক্ষেপ সর্বসাম্প্রতিককালে নেওয়া হচ্ছে – সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হচ্ছে, ঋণের সুদ হার হ্রাসের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু মূল সময়গুলো অধরাই রয়ে যাচ্ছে। অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো থেকে যাচ্ছে। কারণ প্রকৃত কার্যকারণ চিহ্নিত করা হচ্ছে না। করদাতাদের টাকা দিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর পুনঃপুঁজীকরণ করতে হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে আস্থা আনার জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে যে সক্রিয়তার প্রয়োজন, তার অভাব ক্রমান্বয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। ফলে ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস করার যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা কার্যকর হচ্ছে না। সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার এবং ঋণের হারের ওপর সুদের হারের মধ্যে পার্থক্য কমানো যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণের সমস্যা আর্থিক খাতের শৃঙ্খলাকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং বিনিয়োগের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
দুঃখের বিষয় হলো, যে ধরনের সুদৃঢ় পদক্ষেপ এবং জিরো টলারেন্স নিয়ে খেলাপি ঋণের বিষয়টিকে মোকাবিলা করা উচিত ছিল, সে ধরনের উদ্যম ও উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বরং কিছু পদক্ষেপ – যেমন একই পরিবার থেকে পরিচালক নিয়োগের সংখ্যা ও মেয়াদকাল, খেলাপি ঋণের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের নামে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও রেয়াত ইত্যাদি ব্যাংকিং খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার নিরিখে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব রাখবে। ঋণখেলাপির কার্যকারণ নির্দিষ্ট করে খেলাপিদের ভাগ করা, কারা বিভিন্ন সুবিধা নিয়েও ঋণখেলাপি থেকে যাওয়াকেই ভালো ‘বিজনেস মডেল’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করা, আইনের সংস্কার ও প্রয়োগ এসব বিষয়ে কোনো উদ্যম দেখা যাচ্ছে না। এর বিপরীতে বরং বড় ও ধারাবাহিক ঋণখেলাপিরা বিভিন্ন প্রণোদনা পাচ্ছেন। ফলে যারা ভালো ঋণ গ্রাহক, তাদের জন্য এক ধরনের নৈতিক বিপত্তি (মোরাল হেজার্ড) সৃষ্টি হচ্ছে। তারা অনুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন, কেন না তারা দেখছেন যে খেলাপি হলে তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা এবং সুশাসনকে শক্তিশালী করতে হলে বিদ্যমান আইনের সংস্কার প্রয়োজন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে কিছু উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন ঋণ পুনরুদ্ধার কোম্পানি -গঠন করে খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা। এসব উদ্যোগ তখনই সফল হবে, যখন ঋণখেলাপিরা দেখবে যে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে এবং কাউকেই অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, তার স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করত হবে। তাহলেই শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতির যৌক্তিকতা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে আর্থিক খাত পরিচালনার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।
সামনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট আসছে। এ বাজেটের বাস্তবায়নে ব্যক্তি খাতের বড় ভূমিকা থাকবে। জিডিপিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, যা বর্তমানে জিডিপির ২৪ শতাংশ আছে, সেটাকে ক্রমান্বয়ে ৩০ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। ব্যক্তি খাতকে প্রণোদিত করতে হলে ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস করতে হবে। আর সেটা করতে হলে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলার দিকে নজর দিতে হবে এবং এটা করতে হবে অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তাকে মাথায় রেখে। এ ক্ষেত্রে অনেক ধরনের চাপ থাকবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের আলোকিত স্বার্থপরতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্য অনেক দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি, আর্থিক খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব অর্থনীতির অন্যান্য খাতকেও সংক্রামিত করে। সুতরাং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাধিকার দিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
আমরা সম্প্রতি দেখছি, নতুন নতুন অনেক ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। তুলনীয় অন্য অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। এ ক্ষেত্রে আমানত সংগ্রহে সমস্যা হচ্ছে; ঋণ বিতরণে সমস্যা হচ্ছে; খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে এটাও ভূমিকা রাখছে। নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমতি না দিয়ে বরং বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর দক্ষ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও মার্জার ও একুইজিশনকে প্রণোদিত করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ব্যাংকের সুদের হার এক অঙ্কে নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির মৌলিক সূত্র না মেনে তা করা যাবে না বা করার চেষ্টা করা হলেও তা টেকসই হবে না। প্রথমত, আমানতকারীর প্রকৃত সুদ যাতে ইতিবাচক থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতির বিবেচনায় তা ঋণাত্মক হলে আমানতকারীরা অনুৎসাহিত হবেন এবং নিজের কাছে নগদ টাকা রাখতে চাইবেন। ফলে তারল্য সংকট দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংককে তার লাভ্যতার নিরিখে ব্যাংকঋণের সুদ নির্ধারণ করতে হয় – এটি বিবেচনায় নিতে হবে। তৃতীয়ত, স্প্রেড (ঋণ ও আমানতের সুদের হারের পার্থক্য) ব্যাংকের দক্ষতার ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই তিন বিবেচনা পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং, ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস করতে হলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং ব্যাংক কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি – তিনটিরই সমন্বয় করতে হবে। ওপর থেকে সিদ্ধান্ত দিয়ে চাপিয়ে দিলে তা যে টেকসই হবে না, সে অভিজ্ঞতা আমাদের এরই মধ্যে হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনকে তাই কোনোক্রমেই হুমকির মুখে ফেলা যাবে না। সে ক্ষেত্রে আর্থিক খাতে যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমরা সিপিডির পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার কথা বলে আসছি। ভূতপূর্ব অর্থমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলেন এবং এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনের কথাও বলেছিলেন। প্রস্তাবিত কমিশনের ম্যান্ডেট হতে পারে নিম্নের বিষয়গুলোর ওপর সুচিন্তিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চিহ্নিত করা – খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য সমস্যার মূল চিহ্নিতকরণ; আইনি কাঠামোর সংস্কার; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা বিধান; ব্যাংক বোর্ডের গঠনের জন্য নীতিমালা; আইন প্রয়োগে সমস্যার চিহ্নিতকরণ এবং আইনের পরিবর্তন। কমিশন ব্যাংকিং খাতের দক্ষ, যুগোপযোগী ও সুশাসনভিত্তিক পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেবে। সরকারকে সেসব পরামর্শ বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে এ ধরনের একটি উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশকে একবিংশ শতাব্দীতে মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে অগ্রসর হতে হলে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে হলে, দেশের আর্থিক খাতকেও এসব অভীষ্টের সঙ্গে সংগতি রেখে সমান্তরালভাবে কাজ করতে হবে। এ দুয়ের মধ্যে যদি বড় পার্থক্য থেকে যায়, তাহলে শুধু আমাদের অভীষ্টসমূহই অনর্জিত থেকে যাবে না, যা অর্জন করেছি তাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।