Published in Kaler Kantho on Wednesday, 5 March 2014.
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে সর্বত্র
মাহমুদুর রহমান মান্না
এটা এখন পরিষ্কার যে সরকার আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়াতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়বে গ্যাসের দামও। এর আগে ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আড়াই বছরে আরো পাঁচবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে মোট ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ দাম বেড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম হয়েছে এখন পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা।
এখন বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ছে। চলতি মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে লিখিত আবেদন করেছে। পত্রপত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, এতে প্রতীয়মান হয়, বিদ্যুতের দাম আবার বাড়বে। খোদ প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রদত্ত বক্তৃতায় এ রকম ইঙ্গিত করেছেন। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী রীতিমতো সতর্ক করে দিয়েছেন সবাইকে। চিৎকার করে কোনো লাভ নেই। দাম বাড়াতে হবে। তিনি বরং গ্রাহককে ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এ রকম কথা বলতেই পারেন, যদিও তাঁর কথা বাস্তব ও সত্য নয়। তা যদি অতীত এবং সত্য আড়াল না করে।
কেন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে? যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বেড়েছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে ছয় টাকা ২২ পয়সার মতো। অথচ তা বিক্রি করা হচ্ছে মাত্র পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সায়।
চট করে এ কথার জবাব দেওয়া যাবে না। এর জবাব দেওয়ার জন্য আমাদের অতীতের দিকে তাকাতে হবে। আমি বলেছি, পাঁচবার দাম বাড়ানোর পর আমরা এ অবস্থায় এসেছি। তাহলে শুরুটা এত খারাপ ছিল না। দাম এবং উৎপাদন খরচ তো কম ছিল। বাড়ল কেন? বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থায় পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবহেলা করা হয়েছে। কম পয়সায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এ রকম সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলোকে দিনের পর দিন অবহেলা করা হয়েছে। মেরামতের পয়সা দেওয়া হয়নি। গ্যাস সরবরাহ করা হয়নি। সামান্য কিছু টাকা খরচ করলে যেখানে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আরো সচল করা যেত, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যেত, তা করা হয়নি। এ কাজে কয়েক দশক ধরে সরকারগুলো অবহেলা করেছে। বরং তার বদলে নানা উপায়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে বিদ্যুতের লোডশেডিং সৃষ্টি করে আওয়াজ তোলা হয়েছে, যেকোনো মূল্যে বিদ্যুৎ চাই। এটা ছিল আমাদের বিদ্যুৎব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক সর্বনাশা ষড়যন্ত্র। এ আওয়াজ তুলে যেকোনো দামে, টেন্ডার ছাড়া, একক চুক্তিতে অত্যন্ত চড়া দামে বেসরকারি খাতে, ব্যক্তিমালিকানায় রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। সরকারি জমিতে, সরকারি পয়সায় ভর্তুকি দেওয়া চড়া দামের জ্বালানি তেল ব্যবহার করে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের গোটা বিদ্যুৎব্যবস্থাকে বিপর্যয়কর জায়গায় নিয়ে গেছে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। ২০০৯ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো যেখানে ২ দশমিক ৫০ টাকায়, ২০১৪ সালে তা এসে পৌঁছেছে ৬ দশমিক ২২ টাকায়। ২০০৯ সালে গ্রাহককে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য দিতে হতো ৩ দশমিক ৮৩ টাকা, ২০১৩ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৫ টাকায়। এ চাপ সামলাতে সরকার উপর্যুপরি বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে যে বিদ্যুৎ এসেছে, তার উৎপাদন দাম পড়েছে গড়ে ইউনিটপ্রতি আট থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। আজ এ দায়ভার জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে।
সরকারের বক্তব্য ছিল, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল লোডশেডিং মোকাবিলায় সাময়িক পথ। সে বক্তব্য মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে সমর্থনও করেছিল। পরিস্থিতি এমনই অসহ্য জায়গায় নেওয়া হয়েছিল যে সাধারণ গ্রাহকরা যেকোনোভাবে এর থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছিলেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞজনরা তখনো বলেছিলেন, বিশ্বব্যাপী কুইক রেন্টালের অভিজ্ঞতা কিন্তু ভালো নয়। আর সরকার, প্রশাসন যদি অনভিজ্ঞ হয়, দুর্নীতিবাজ হয়, তবে এগুলো জাতীয় অর্থনীতিকে ধরে টান দেয়।
সাংবাদিক শুভ কিবরিয়া বলেন, এখন দেখা যাচ্ছে তা স্থায়ী ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চড়া দামের জ্বালানি তেল ব্যবহার করে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এমন সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ সরকার উপর্যুপরি বাড়াচ্ছে। তা ছাড়া বিদ্যুৎব্যবস্থাপনায় রয়েছে মহাদুর্নীতি। বিদ্যুতের হাজার হাজার কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছ ব্যবস্থা স্থায়ী করে কেনা হচ্ছে নিম্নমানের ট্রান্সফরমার, মিটার, তারসহ বিদ্যুতের সরঞ্জামাদি। এসব নিম্নমানের বিদ্যুৎ সরঞ্জাম পুরো বিদ্যুৎব্যবস্থায় দক্ষতা কমাচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের মান কমেছে। যার নিট ফলাফল হচ্ছে উৎপাদন ও সরবরাহ মূল্য বেড়ে যাওয়া।
একসময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী একক প্রতিষ্ঠান ছিল পিডিবি বা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। সিস্টেমলস কমাতে, প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়াতে দিনের পর দিন পিডিবিকে ভেঙে ডেসা, ডেসকো, ডিপিডিসি নামের প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ ভরে ফেলা হয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের আমলাদের দিয়ে। ফলে নতুন প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়েনি, তবে খরচ বেড়েছে। নতুন অফিস, নতুন লোক, নতুন ট্রান্সপোর্ট কেনায় বেড়েছে খরচ, তার চাপ পড়েছে পুরো বিদ্যুৎব্যবস্থায়। ফলে দিন দিন বিদ্যুতের দাম কমার বদলে বাড়ছে।
পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, যে সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে সরকার ২০০৯ সালে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে এবং বেশি দামের বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, সে অনুযায়ী এ বছর থেকেই বিদ্যুতের দাম কমার কথা। অথচ ১ মার্চ থেকে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
মূলত সরকার তার মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন করে অপেক্ষাকৃত কম দামের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণেই এখন আবার দাম বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, গত পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের সাফল্য প্রধানত তরল জ্বালানিনির্ভর ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ও পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে। এই জরুরি উদ্যোগ অবশ্যই অপরিহার্য ছিল। কিন্তু এসব কেন্দ্রের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। ২০০৯ সালের ওই পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্টভাবে হিসাব করে দেখানো হয়েছিল, তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ও পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র করায় বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে ২০১২-১৩ সালে। এরপর গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে চালু হতে থাকলে ২০১৩-১৪ সাল থেকে বিদ্যুতের দাম কমবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দেখিয়েছিল, ২০১৩-১৪ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় হবে চার টাকা ৩২ পয়সা। এর পরের বছর তা আরো কমে হবে তিন টাকা ৯৮ পয়সা।
অথচ পিডিবির সর্বশেষ অভ্যন্তরীণ প্রাক্কলন অনুযায়ী আগামী বছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় আরো বেড়ে হবে ছয় টাকা ২৭ পয়সা।
বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি তেল সরবরাহে সিস্টেম লসের যে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা রয়েছে, যে চুরি বিদ্যমান আছে, তা দেখার দায়িত্ব যাদের, সেই বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের আমলারাই আবার এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ ভরে ফেলেছেন। যে সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধিদের দেখার কথা ছিল জনস্বার্থ, সেই তাঁরাই কুইক লাভের বিদ্যুৎ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে দলবাজ একদল বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যাঁরা বলেন, বিদ্যুৎ চাইলে দাম দিতে হবে।
দাম বাড়ানোর অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। তাই রাজস্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দাম বাড়ানো অপরিহার্য নয়। তা ছাড়া প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে, বিনিয়োগ নেই। উৎপাদন পরিস্থিতিও দুর্বল। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে অর্থনীতি একটা বাড়তি চাপের মুখে পড়বে।
দেশে মূল্যস্ফীতি এখন ৮ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াবে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়বে। কৃষিকে এই দাম বৃদ্ধির আওতায় রাখা হলে সেখানেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এসব বিষয় সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ না করে শুধু ভর্তুকি সুষমকরণের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফল ভালো হওয়ার কথা নয় বলেও মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
বিশেষজ্ঞরা মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর কথা ঠিক নয়। মানুষকে ধমক দিয়ে জোর করে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিলে তা অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলবে, জনদুর্ভোগ বাড়াবে।
অবিলম্বে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখক : আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য mrmanna51@yahoo.com