Published in Daily Sangram on Thursday, 6 March 2014.
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিইআরসির গণশুনানী আইওয়াস মাত্র!
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির যাতাকলে পিষ্ট হবে সীমিত আয়ের মানুষ
০ ৫টি বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের প্রস্তাবে গড়ে ৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর পক্ষে বিইআরসি
০ ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লোকসানের বোঝা গ্রাহকদের কাঁধে
কামাল উদ্দিন সুমন : সরকারের চাপেই এবার বাড়তে যাচ্ছে বিদ্যুতের দাম। সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা বলেছেন। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই সরকারি ইচ্ছার বাইরে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। বিদ্যুতের দামের সঙ্গে বাড়বে সীমিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগ। আর এই খাতে বিনিয়োগকারীরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার কথা থাকলেও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মতো প্রতিষ্ঠান নির্দেশ পালনের বাইরে তেমন কোনো তৎপরতা দেখাতে পারছে না।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে ৫টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি বর্ধিত দামের প্রস্তাব বিইআরসির কাছে দেয়ার ১৫ দিনের মধ্যে বিদ্যুতের দাম নিয়ে শুনানী শুরু করে বিইআরসি। ৪ জানুয়ারি থেকে শুরু করে আজ বৃহস্পতিবার চলবে এ শুনানী। গতকাল বুধবার ডেসকো আর ডিপিডিসির প্রস্তাবিত দাম নিয়ে শুনানী হয়। ডেসকো ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ২ দশমিক ০১ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করবে বলে জানা যায়। এর আগে ডিপিডিসি ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে বিইআরসি ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ বাড়ানোর সুপরিশ করবে বলে জানা যায়। গত মঙ্গলবার পিডিবি ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ওজোপাডিকো ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিলে বিইআরসি ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ বাড়ানোর সুপরিশ করবে বলে জানা যায়। আরইবির গ্রাহকদের ইউনিট প্রতি ৬৯ পয়সা বা ১২.৫৬ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার শুনানী হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, সরকারের দুর্নীতি ও ভুল নীতির কারণেই সস্তা বিদ্যুৎ অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে দেশের জনগণকে। দেশি-বিদেশি কয়েকটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে সরকার দেশের জ্বালানি খাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মত তাদের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো টানতে গিয়েই তার মাশুল দিচ্ছে গ্রাহকরা। স্বল্পমেয়াদি রেন্টাল প্রকল্প এখন কোথাও কোথাও ১৫ বছর মেয়াদি হয়ে গেছে। যেগুলো বড় মেয়াদে চুক্তি করতে পারেনি, সেগুলোরও মেয়াদ বাড়ছে বছর বছর। যদিও সরকারি হিসাবেই বলা হয়, সরকারি খাতের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটে খরচ পড়ে ২ টাকা ৯০ পয়সা। অন্যদিকে রেন্টালে উৎপাদন হলে এ খরচ পড়ে গড়ে ৪ টাকা ৮০ পয়সা। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন ব্যয় প্রতিইউনিট সাড়ে পাঁচ টাকারও বেশি। আবার তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রায় ১৬ টাকা। হিসাব মতো তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ১হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভুতর্কি গুণতে হয় ২৮ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা গ্রাহকদের নিকট থেকে তুলে নিতে দাম বাড়ানো হচ্ছে ।
সূত্র জানায়, রেন্টালের বাড়তি দাম ও মালিকদের লাভ এবং এই খাতে কম দামে গ্যাস ও তেল দিতে গিয়েই সরকারের লোকসান বাড়ছে। পাশাপাশি রেন্টালে প্রদর্শিত হিসাবের চেয়ে উৎপাদন হয় কম। পুরনো মেশিনপত্র হওয়ায় কোনো রেন্টালই ভালো উৎপাদন করতে পারে না। অধিকাংশ মেশিনই তেল টানে বেশি। এসবের মধ্যে আরও আছে রাজনৈতিক লাভালাভের হিসাব। সরকারের পছন্দের ব্যবসায়ীদের রেন্টাল কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। কিন্তু চুক্তি মোতাবেক বন্ধ থাকলেও টাকা পায় তারা। অজুহাত হিসেবে দেখানো হয় সরকার তেল দিতে পারেনি বিধায় বন্ধ ছিল।
সরকারের পক্ষ থেকে হিসাব দেয়া হয়েছে, বিদ্যুৎখাতের ভর্তুকি একটা সামঞ্জস্য পর্যায়ে রাখতেই দাম বাড়াতে হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদ্যুৎখাতে সরকারের ভর্তুকি ছিল ৯৯৩ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০১০-১১ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৪ হাজার কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
সূত্র জানায়, বিদ্যুতের দাম এবার বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরা। এবারের সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে তাদের পরিকল্পনার বাইরে অতিরিক্ত ব্যয় যোগ হবে, যা সামাল দিয়ে উঠতে পারবেন না অনেকেই।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। তাই রাজস্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দাম বাড়ানো অপরিহার্য নয়। সম্প্রতি দেশে প্রবৃদ্ধির হারও কমছে। বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। উৎপাদন পরিস্থিতিও দুর্বল। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে অর্থনীতি একটা বাড়তি চাপের মুখে পড়বে।
তারা জানান দেশে মূল্যস্ফীতি এখন ৮ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়বে। কৃষিতে এই মূল্যবৃদ্ধি ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এসব বিষয় সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ না করে শুধু ভর্তুকি সুষম করণের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফল ভালো হবে না।
এদিকে বিইআরসির ভূমিকা সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন বলে মনে করছেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট অনেকে। তাদের মতে বিইআরসির কাজ হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাত নিয়ন্ত্রণ করা। দেশ ও জনগণের চাহিদা ও স্বার্থের কথা মাথায় রেখে নীতি প্রণয়ন করা। কিন্তু দফায় দফায় ফরমায়েশ অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া তারা এক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিইআরসির উচিত বিদ্যুতের মূল্য কমানো কিন্তু কখনোই কোনো গণশুনানিতে তারা বিদ্যুতের মূল্যহ্রাসের কোনো যুক্তি খুঁজে পায়নি।
আইনে বলা আছে, জ্বালানি পণ্যের মূল্য বছরে একবারের বেশি বাড়ানো যাবে না। অথচ গেল মেয়াদে এক বছরে ছয়বার মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল।
তবে বিইআরসির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদের দাবি জনগণের সাথে তাদের শক্রতা নেই। কোম্পানীগুলো দাম বাড়ানোর ব্যাপারে প্রস্তাব দেয় তা নিয়ে শুনানী হয়। আর শুনানী করে মূল্যবৃদ্ধির রায় দেয়া হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আল বলেন, বিইআরসিতে একতরফা শুনানি হয়। ফলে রায় সব সময় সরকারের পক্ষেই যায়। বলা যায় যে, এই পরিস্থিতিটা তৈরি করে রাখা হয়েছে। প্রক্রিয়াগুলো এমনই যে, এতে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনের স্বার্থ রক্ষা হবে। আবার এটাও ঠিক যে, শুনানিতে সবাই যায় না। প্রস্তুতি নিয়ে অনেক মানুষ এলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের কারণেই মূলত বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে এবং তা জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে।
তেল-গ্যাস-খণিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের মতে, জ্বালানিখাত নিয়ে সরকার যেভাবে এগোচ্ছে তাতে বিদ্যুতের দাম এভাবে বার বার বাড়াতে হবে। সরকারের দুর্নীতি ও ভুল নীতির কারণেই সস্তাবিদ্যুৎ অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে দেশের জনগণকে। সরকার যদি সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করতো তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো তো দূরের কথা, এখন বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য বোর্ড বসানো হতো।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, স্থায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে নজর না দিয়ে সরকার রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে নিজেদের পকেটে টাকা ভরছে। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। কালো আইন করে সরকার এসব সুবিধা নিচ্ছে। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চাপে সরকার অনেক বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এখন জনগণের পকেট কাটতেই নতুন করে দাম বাড়ানোর এ পরিকল্পনা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একটি গণমাধ্যমকে বলেন, আমি তো তেলের মূল্যবৃদ্ধির কোনো খবর শুনিনি। তাহলে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এই হই চই কেন? বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং সেই সূত্রে প্রবৃদ্ধি, সবগুলোর অবস্থাই খারাপ। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে অর্থনীতি একটা বাড়তি চাপের মুখে পড়বে। চলতি সেচ মৌসুমে কৃষকরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও হ্রাস পাবে। অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। খাদ্যপণ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়বে।