Published in Daily Sangram on Saturday, 15 March 2014.
কামাল উদ্দিন সুমন : শেষ পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বাড়ালো সরকার। চলতি মার্চ মাস থেকেই গ্রাহকদের নতুন মূল্যহারে বিদ্যুতের বিল দিতে হবে। আর দাম বৃদ্ধির ফলে বেড়ে যাবে সকল ধরনের ব্যয়ভার। এটা সামাল দিতে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের মানুষের নাভিঃশ্বাস অবস্থা সৃষ্টি হবে। সকল ধরনের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আরও নিরুৎসাহিত হবে, বাড়বে মূল্যস্ফীতি। সব ধরনের গ্রাহককে বিদ্যুৎ খাতে বাড়তি ব্যয় করতে হবে।
সূত্র জানায়,সরকারের আয় কমে গেছে। রাজস্ব আদায় কম। তবে ব্যয় কমেনি। বেড়েছে ভর্তুকি ব্যয়। সরকার এখন বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কিছুটা কমাতে চাইছে। তবে এতে সরকারের ভর্তুকি কমলেও বাড়বে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের দুর্নীতি আর ভুলনীতির কারণে যে লোকসান হচ্ছে তা পুরোটাই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের ওপর।
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বৃহস্পতিবার গ্রাহক শ্রেণী-নির্বিশেষে প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম বেড়েছে গড়ে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। নতুন দামে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণী । কারণ তাদের প্রতিমাসে গড়ে খরচ হয় ৪ শ ইউনিট থেকে ৬শ ইউনিটের মধ্যে। এজন্য তাদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে ৪৪৫টাকা বেশি। অর্থাৎ যে গ্রাহক ৪০১ ইউনিটের জন্য আগে ২৯৬৭ টাকা বিদ্যুৎ বিল প্রদান করতেন তাকে এখন ৩৪১২ টাকা বিল দিতে হবে। ৪০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর অতিরিক্ত বাড়বে ১৩৫ টাকা,৩৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে ১১১ টাকা ২৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে মাসে ৬৮ টাকা ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে ৫০ টাকা। এ ছাড়া ১৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে ৩৬ টাকা,১০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিল বাড়বে মাসে ২২ টাকা ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর বাড়বে ১৫টাকা।
এদিকে শুধু বিদ্যুৎ বিল বেশি দিতে হবে এমনটাই নয়। এর সঙ্গে জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ । কোনো কোনো বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাব অনুযায়ী নানা ধরনের সার্ভিস চার্জ, বিলম্ব মাশুল প্রভৃতিও অপরিবর্তিত রয়েছে। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে যত বেশি ব্যবহার, তত বেশি বিল এ নীতির প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। এতে সম্পন্ন বা ধনী আবাসিক গ্রাহকের ওপর মূল্যবৃদ্ধির হার বেশি বর্তাবে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত বিইআরসির আদেশে নতুন মূল্যহার ‘বিল মাস মার্চ ২০১৪’ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে প্রায় সব গ্রাহক বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, কোনো মাসের ১ তারিখ থেকে ৩০ তারিখের ব্যবহার হিসাব করে ওই মাসের বিদ্যুৎ বিল করা হয় না। যেমন মার্চ মাসের জন্য যে বিল গ্রাহককে দেয়া হয়, তার মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসেরও কিছুদিনের ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত থাকে। তাই ‘বিল মাস মার্চ’ থেকে নতুন মূল্যহার কার্যকর করা হলে প্রায় সব গ্রাহককেই ফেব্রুয়ারি মাসেরও কিছুদিনের বিল বর্ধিত হারে দিতে হবে।
বিইআরসি দেয়া এবার গড়ে দাম বাড়ানো হয়েছে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে পিডিবির গ্রাহকদের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। ডিপিডিসির ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ডেসকোর ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। পল্লী বিদ্যুতের ৫ দশমিক ৪১ এবং ওজোপাডিকোর ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতির হার আবারও বাড়বে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর জানুয়ারি মাসে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এদিকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এতে সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পসহ বৃহৎ শিল্পের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে এই মূল্যবৃদ্ধি। জিনিসপত্রের দাম আরো এক ধাপ বাড়বে। বিশেষ করে নি¤œ ও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে উঠবে। এ মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণও ক্ষোভ জানিয়েছে। তারা বলছেন, সুস্থভাবে বাঁচাতো দূরের কথা, ব্যয়বহুল এই নগরে এখন টিকে থাকাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে তাদের জন্য।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি ও বিনিয়োগের পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যথার্থ সময় এটি নয়। কারণ, বিনিয়োগ পরিস্থিতি এমনিতেই ভালো নয়। তার ওপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কিছুটা হলেও বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম থাকায় বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়ারও আশঙ্কা ছিল না। দাম বাড়ানোর একমাত্র কারণ সরকারের ভর্তুকি কমানোর নীতি। সেটা বিচ্ছিন্নভাবে একেক সময় একেক খাতে দাম বাড়িয়ে কমানোর চেষ্টা খুব কার্যকর হবে না। সরকারের উচিত আগামী বাজেটের আগে সামগ্রিক ভর্তুকি নীতি পুনর্বিবেচনা করা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন,বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ফলে সামগ্রিকভাবে পণ্যের ক্রয়মূল্য বেড়ে গেলেও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় বাড়বে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর।
মূল্য বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুৎভিত্তিক বিভিন্ন পণ্যের দামও বাড়বে। ফলে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনের ব্যয়ভার বেড়ে যাবে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর খরচ বাড়বে সবচেয়ে বেশি। আর সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতির ওপর।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনের ওপর বহুমাত্রিক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এর ফলে কৃষি এবং শিল্প খাতের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে শুধু বিদ্যুতের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট জিনিসপত্রের দাম বাড়বে তা নয়, বাড়িভাড়াও বাড়বে। ফলে মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় আরো একধাপ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, দাম বাড়ার ফলে বিশেষ করে স্থির ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর একটা চাপ পড়বে। ফলে উৎপাদক পর্যায়ে ব্যয় বাড়বে, সেটা আবার ভোক্তার ওপর গিয়েই পড়বে। সামগ্রিকভাবে এটি ভোক্তার জন্য মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করবে।