Published in যায় যায় দিন on Saturday, 13 February 2016
অভিন্ন ভ্যাটে আপত্তি ব্যবসায়ীদের
মেসবাহুল হক
আসছে জুলাইয়ে শুরু হওয়া বাজেট থেকেই নতুন ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) বা মূসক আইন বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রায় সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ছকে প্রস্তুত ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এনবিআরের দূরত্ব এখনো কমেনি। আইনের অনেক ধারা-উপধারা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও মূলত সবপণ্য ও সেবায় অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপেই প্রধান আপত্তি ব্যবসায়ীদের।
আগে শুধু আমদানি, উৎপাদন, ব্যবসায়িক স্তর ও সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করা ছিল। বর্তমান আইনে অস্থাবর সম্পত্তি, লাইসেন্স পারমিট ইত্যাদিও ভ্যাটের আওতায় আনা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে ব্যবসায়ীরা তাদের বার্ষিক টার্ন ওভারের বিভিন্ন সীমার ওপর নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট দেন। যা প্যাকেজ ভ্যাট নামে পরিচিত। কিন্তু নতুন আইনে সর্বক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্যাকেজ ভ্যাটের সুবিধা তুলে দেয়া হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, নতুন আইনে সব ধরনের সেবা ও পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা দিতে পারবে না। কারণ এখন পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট দেয়ার মন-মানসিকতা পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। কিন্তু ভ্যাট কর্মকর্তারা বিক্রির ওপর ভ্যাট নির্ধারণ করলে তা ব্যবসায়ীকেই দিতে হবে। নতুন আইনে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭ শতাংশ ভ্যাট কার্যকরেরও দাবি জানিয়েছেন তিনি।
অপরদিকে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, নতুন আইন বাস্তবায়ন করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রস্তুত। আগামী ১ জুলাই থেকে চালু হচ্ছে নতুন ভ্যাট আইন। ভ্যাট হবে আমাগী দিনের রাজস্বের ভবিষ্যৎ। নতুন ভ্যাট আইন অবশ্যই ব্যবসায়ী বান্ধব বলেই দাবি তার। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য অনলাইনে ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যখন অনলাইনে এনবিআরে ভ্যাট জমা দেবেন তখন আয়ও অনেক বেড়ে যাবে।
এদিকে আইনের অন্য অংশ নিয়েও আপত্তি রয়েছে ব্যবসায়ীদের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আদালতের আদেশ ছাড়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অপরিচালনাযোগ্য করা, সম্পত্তি ক্রোক করা ইত্যাদি। এসব বিষয়ে ব্যবসায়ীদের বিরোধিতায় আইন সংশোধন করে কিছুটা নমনীয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এখন সেই উদ্যোগও কার্যকর করা যাচ্ছে না। ফলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এনবিআর সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত হচ্ছে সংসদে পাস হওয়া ভ্যাট আইনটিই কোনো সংশোধন ছাড়াই কার্যকর করতে হবে। কিন্তু আইনটি সংশোধনে সরকার গঠিত পর্যালোচনা কমিটি সম্প্রতি তাদের সুপারিশে আইনে বড় দুটি ইস্যুতে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। এ নিয়েই নতুন করে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইএমএফ অতিমাত্রায় খবরদারি করছে, কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী সংস্থাটি এটি করতে পারে না। যদি তাই হয় তাহলে ব্যবসায়ীদের নিয়ে পর্যালোচনা কমিটি করার দরকার কি ছিল?
এফবিসিসিআই পরিচালক আবু মোতালেব বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য প্যাকেজ ভ্যাট চালু রাখতে হবে। প্রয়োজনে প্রতি বছর ভ্যাট হার বাড়ানো যেতে পারে। এ ছাড়া বার্ষিক বিক্রয়সীমা (টার্নওভার) ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ২ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন বলেও হুশিয়ারি দেন তিনি।
ঢাকা চেম্বারের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি হুমায়ুন রশিদ বলেন, প্যাকেজ ভ্যাট বাতিল করলে বিপাকে পড়বেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। টার্নওভার ভ্যাট (মোট বিক্রয়ের ওপর ভ্যাট) আরোপ করলে বার্ষিক ২৪ লাখ টাকা টার্নওভারের ওপর ৩ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে, যা বাস্তবতার নিরিখে অযৌক্তিক। পুরান ঢাকার অনেক ছোট ব্যবসায়ীর টার্নওভার ২৪ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু এই টার্নওভারে ১ থেকে ২ শতাংশ কমিশন পায় না অনেক ব্যবসায়। তাহলে সে কীভাবে ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দেবে?
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ভ্যাট থেকে আয় বাড়ানো প্রয়োজন আছে। তবে এক ধাক্কায় সর্বক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কতটা যুক্তিযুক্ত সেটাও ভাবতে হবে। এটা এক অঙ্কের ঘরে নিয়ে আসা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার। এ ছাড়া সব পণ্যের ওপর সামানহারে ভ্যাট প্রয়োগ না করে ভিন্ন ভিন্ন পণ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাট প্রয়োগ করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, এখন যেহেতু ছোট ব্যবসায়ীরা প্যাকেজ ভ্যাট দিয়ে থাকেন সেটার বিলুপ্ত ঘটালে এর বিকল্প কিছু রাখা উচিত।