Published in আমাদের সময় on Thursday, 31 December 2015
বহুমুখী চ্যালেঞ্জে রপ্তানি খাত
রুমানা রাখি
দেশে দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই, কিন্তু এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। এর মধ্যে নিরাপত্তাজনিত কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রের জারি করা সতর্কতায় বাংলাদেশে বিদেশিদের আগমন কমেছে। আর ডলারের বিপরীতে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় বেড়েছে রপ্তানি পণ্যের দাম। পাশাপাশি ইমেজ সংকট তো রয়েছেই। এছাড়া পরিবেশ, শ্রমিকের অধিকার এসব ইস্যুতেও রপ্তানি খাত বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আবার গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর ফলে সার্বিকভাবে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। এতে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রপ্তানি আয়ে। গত নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় অর্জিত হলেও পুরো অর্থবছরের অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশীষ বসু বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে বাধাগুলো দূর করতে বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোতে নিয়োজিত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের মাধ্যমে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি কিছুটা কমেছে। অন্য যেসব দেশে রপ্তানি কমেছে, সেসব দেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের কাছে রপ্তানি কমার কারণ সম্পর্কে জানতে চওয়া হয়েছে।
শুভাশীষ বসু আরও বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশের চালের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তাছাড়া চালের কুঁড়ার তৈল উৎপাদনের ক্ষমতা প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের নেই। এই তেল রপ্তানিতে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। জাপানে জুতা ও চিংড়ি রপ্তানির ব্যাপারেও অধিক জোর দেওয়া হয়েছে। এভাবে রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা যেমন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তেমনি রপ্তানির নতুন নতুন বাজারও সৃষ্টি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বছরজুড়েই রপ্তানি খাত ছিল তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে। অস্থিরতাও কাজ করেছে সব সময়। তারপরও সামগ্রিকভাবে রপ্তানি আয় বাড়লেও কিছু পণ্যের আয় কমছে। গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। তাছাড়া প্রচলিত বাজারের বাইরে নতুন বাজারের ব্যাপারে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ না করায় রপ্তানির বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরু থেকেই রপ্তানি খাতে নানামুখী সমস্যা জেঁকে বসেছে। এর মধ্যে বছরের শুরুতে ৫ জানুয়ারি থেকে বিরোধী দলের চলা প্রায় তিন মাসের টানা অবরোধে রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। ওই সময়ে রপ্তানির অর্ডারও কমে গিয়েছিল। বছরের মাঝামাঝি সময়ে কারখানার কর্মপরিবেশ পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার একটি বিশেষ টিম বাংলাদেশে আসে। কারখানার কর্মপরিবেশ মানসম্পন্ন না হওয়ায় ওই সময়ে অনেক গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে হিমায়িত মাছের দাম কমে যাওয়ায় এ খাতের রপ্তানিও কমে যায়। একই অবস্থা হয়েছে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, কৃষিপণ্য ও প্লাসিক পণ্য রপ্তানিতে। বছরের শেষ দিকে এসে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে এ খাতের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যায়। ফলে রপ্তানি খাত আরও প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে।
চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ২৮৭ কোটি ৯৮ ডলার। চলতি অর্থবছরের উল্লেখিত সময়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ২৮৮ কোটি ডলার। এ হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ১ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ১ হাজার ২০৭ কোটি ডলার। আর গত এক বছরের হিসাবে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চলতি অর্থবছরের বাকি ৭ মাসে আরও ২ হাজার ৬২ কোটি ডলার রপ্তানি আয় করতে হবে। এ হিসাবে প্রতিমাসে গড়ে আয় করতে হবে ২৯৫ কোটি ডলার করে, যা প্রায় অসম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিমাসে গড়ে ২৪০ থেকে ২৭০ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্র্রতিক সময়ে বিদেশি ক্রেতাদের ঢাকায় আসার হার কমে যাওয়ায় গার্মেন্ট খাতে অর্ডার কম আসছে। অন্যান্য খাতেও নানা সমস্যায় অর্ডার কমে গেছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান যে হারে কমেছে সে হারে টাকার মান কমেনি। ফলে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানিতে ক্রেতাদের খরচ বেড়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এছাড়া আমেরিকা, ইউরোপসহ কিছু দেশের সঙ্গে সরকারের শীতল সম্পর্ক রয়েছে। এসব কারণে বিদেশে রপ্তানি বাজার তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকরা পুরনো বাজার ধরে রাখতে পারছে না। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবসায়ী এখন নতুন বাজারের সন্ধানে নেমেছে। শুধু প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক ছাড়া চলতি অর্থবছরের গত ৫ মাসে কোনো পণ্যই রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে দেশে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে, তাতে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকা- ব্যাহত হচ্ছে। রপ্তানি খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এ বিষয়ে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দৃশ্যত রপ্তানি আয় বাড়লেও যে পরিমাণ বাড়ার কথা ছিল, তা বাড়েনি। এর জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থার অস্থিরতাকে দায়ী করছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, অভিবাসন ব্যবস্থার কারণে অনেক দেশ আমদানি কমিয়ে দিয়েছে।