Published in দৈনিক ইত্তেফাক on Friday, 30 January 2016
গার্মেন্টস পল্লীর অগ্রগতি নেই
এখনো জমি অধিগ্রহণ হয়নি, বাড়ছে দাম বিকল্প ভাবছেন উদ্যোক্তারা
রিয়াদ হোসেন
বহুল আলোচিত গার্মেন্টস শিল্প পল্লী নির্মাণে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। রাজধানীর অদূরে মুন্সিগঞ্জের বাউশিয়ায় এ পল্লী স্থাপনের জন্য এখনো ভূমি অধিগ্রহণ হয়নি। ইতিমধ্যে ব্যয় ৮ হাজার কোটি টাকা বেড়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। দ্রুত কাজ করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে সরকার এই অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র হাতে দেয়। কিন্তু আড়াই বছর পরও ফল শূন্য। বিষয়টি নিয়ে সমপ্রতি নিজের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও।
এদিকে ক্রমেই জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত পুরো কার্যক্রম শেষে তাতে শিল্প স্থাপন সুবিধাজনক হবে কি না তাও হিসাব কষছেন পোশাক শিল্প মালিকরা। এ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত একাধিক গার্মেন্টস উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এটা এখন ‘ফ্লপ’ প্রজেক্ট। এখনো জমিই অধিগ্রহণ হলো না। অন্যদিকে ৬৫ লাখ টাকা বিঘা জমির দাম এক কোটি টাকা হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এটি আগামী ১০ বছরেও সম্পন্ন হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এটি ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধাজনক না হলে তারা তো বিকল্প খুঁজবে। এ অবস্থায় ঝুলে যেতে পারে এ মেগা প্রকল্প।
শুরুতে গার্মেন্টস মালিকদের নিজস্ব অর্থায়নে চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ওরিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিংস (ওআইএইচ) নামে চীনের একটি কোম্পানির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বিজিএমইএ। কিন্তু কয়েক দফা আশ্বাসের পরও অর্থছাড় শুরু করেনি প্রতিষ্ঠানটি। বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরতের ‘গ্যারান্টি’ চায় তারা।
রাজধানীসহ ভাড়া ভবনের এবং ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা নিরাপদ পরিবেশে নেয়ার জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ রয়েছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর এ কাজে গতি আসলেও তিন বছরেও দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আরো ৫ বছরের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন হবে কি না তাও নিশ্চিত নয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গার্মেন্টস মালিকসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর এ বিষয়ে অঙ্গীকারের অভাব রয়েছে। দেশের নিরাপদ পোশাক খাতের স্বার্থেই দ্রুত গার্মেন্টস পল্লীর কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়া দরকার। ফের একটি রানা প্লাজা বা তাজরীনের মত দুর্ঘটনা ঘটলে দেশের গার্মেন্টস খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইত্তেফাককে বলেন, ‘নিরাপদ পরিবেশে গার্মেন্টস কারখানা যত দ্রুত সরানো যায় ততই ভালো। তবে প্রকল্পটি নানা কারণে উদ্যোক্তাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়নি। অর্থায়নের জটিলতা কাটাতে হলে এটিকে বিনিয়োগযোগ্য করে তুলতে হবে। এ জন্য পুরো প্রকল্পকে একসাথে না নিয়ে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করতে হবে’। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের কাজটির প্রতি শুরুতে নজর দিতে হবে। এর পর ধাপে ধাপে করা যেতে পারে। বিকেএমইএ, বিটিএমএকে যুক্ত করা যেতে পারে।
দেড় দশক আগে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হলেও নানামুখী জটিলতায় অগ্রগতি হয় নি। পরবর্তীতে মুন্সিগঞ্জের বাউশিয়ায় জমি ঠিক করা হলেও কী প্রক্রিয়ায় করা হবে তা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। একই সঙ্গে দেখা দেয় অর্থায়ন জটিলতাও। অবশেষে ২০১৩ সালে কাজটি দ্রুত এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বিজিএমইএকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু প্রায় তিন বছর পার হলেও কার্যকর কিছু করতে পারেনি বিজিএমইএ। সমপ্রতি বিজিএমইএ নেতারা গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে পোশাক পল্লীর ইস্যুটিও আলোচনায় স্থান পায়। সূত্র জানায়, বহুল আলোচিত এ প্রকল্পের কাজ থমকে থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্রুত কাজ করার জন্য আপনারা (বিজিএমইএ) দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। এর চেয়ে সরকারি উদ্যোগে করলেই তো ভালো হতো।
জমির দামসহ সার্বিক ব্যয় ক্রমাগত বাড়ায় এখন গার্মেন্টস মালিকরাও এর সফলতা দেখছেন না। এ পরিস্থিতিতে বিজিএমইএ এখন চেষ্টা চালাচ্ছে জমির দাম কমানোর জন্য। বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, জমির দামসহ পুরো প্রকল্পের খরচ ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে। শুরুতে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার খরচের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা দাঁড়িয়েছে ২৩০ কোটি ডলারে। চীনের কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা চললেও এখনো চূড়ান্ত কিছু হয় নি। তারা সময় নিচ্ছে। এ মাসে অর্থায়নের বিষয়ে জানাতে পারে।
তিনি বলেন, এটি ধীর গতিতে হলে সরকারের অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) প্রকল্পে গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের জন্য প্লট পাওয়া যাবে। অন্য জায়গায়ও প্লট পাওয়া যাবে। আমাদের জন্য তো বিকল্প আছে। তবে বাউশিয়ায় গার্মেন্টস পল্লী করতে পারলে ভালো হবে।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের দুই দিন পর গত সপ্তাহে পোশাক মালিক সংগঠনের নেতা, চীনের অবকাঠামো নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওআইএচ এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে চীনের অর্থ ছাড় শুরু না হওয়ায় কারণ জানতে চাওয়া হয়। জবাবে চীনের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিশাল অঙ্কের অর্থ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র নেয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় লাগছে। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সহ-সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন বিকল্প চিন্তা করতে হবে। তবে বিকল্প চিন্তা কী তা খোলাসা করেন নি তিনি’।
নিরাপদ কর্মপরিবেশে নির্বিঘ্নে উত্পাদনের উপযোগী একটি পোশাক পল্লী নির্মাণের লক্ষ্যে বাউশিয়ায় ৫৩১ একর জমি বরাদ্দ দেয় সরকার। ২০১৪ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় এ প্রকল্পের পুরো নির্মাণের লক্ষ্যে দেশটির ইআইএচ কোম্পানির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।
সমঝোতা অনুযায়ী, ভবন নির্মাণসহ প্রকল্পের পুরো কাজ তারা করে দেবে। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণ, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুত্, ইটিপি স্থাপন, ভবন নির্মাণে এ অর্থ খরচ হবে। এর পর কারখানা মালিকরা সুদসহ নির্দিষ্ট কিস্তিতে এ অর্থ পরিশোধ করবেন।