Published in দৈনিক সংবাদ on Wednesday, 13 January 2016
বছরব্যাপী চেষ্টার পরও ফিরে পায়নি জিএসপি
গৌতম ঘোষ
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা বা জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স (জিএসপি) ফিরে পেতে বছরব্যাপী চেষ্টা করা হলেও তেমন কোন সাফল্য আসেনি। জিএসপি সুবিধা স্থগিতে আর্থিক ক্ষতির থেকেও বেশি ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির। সরকার অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের দেয়া ১৬টি শর্ত ইত্যোমধ্যে পূরণ করেছে বলে দাবি করলেও তাতে সন্তুষ্ট নয় যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য জিএসপি ফিরে পেতে সরকারকে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। যুক্তরাষ্ট্র কি কারণে জিএসপি দিচ্ছে না তা সুস্পষ্টভাবে জানাতে চাপ দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।এদিকে গার্মেন্টসে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক সংগঠন ইস্যুতে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের নজরদারিতে কারখানা শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টিতে কিছুটা সাফল্য দেখালেও ইপিজেডগুলোতে ট্রেড ইউনিয়নসহ অন্যান্য ইস্যুতে তেমন কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি। এছাড়া মানসম্পন্ন উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির বদলে পুরনো অনেক অর্ডার ফেরত গেছে। গত দুই বছরে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ১ হাজার ৬৯৩টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এই ভাবমূর্তি সঙ্কটে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরির পাশাপাশি পণ্য রপ্তানি ও প্রবেশ বাধা প্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিএসপি বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খুব একটা জরুরি নয়। তবে জিএসপি ইস্যু আন্তর্জাতিক বাজারে বাণিজ্যিক সক্ষমতার পাশপাশি বাংলাদেশের ইমেজে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু নেতিবাচকতা বাদ দিলে এই সময়ের মধ্যে নানা ইতিবাচক অর্জনের কারণে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বলও হয়েছে। জাতিসংঘসহ বেশ কিছু সংস্থা এসব অর্জনের স্বীকৃতি ও পুরস্কারও দিয়েছে বাংলাদেশকে। তবে নতুন করে জিএসপি পাওয়ায় সুবিধা ভোগকারী দেশগুলোর বাণিজ্য সক্ষমতা বেড়ে যাবে। ফলে ওই সব দেশ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত অক্টোবরে ট্রান্স এশিয়ান প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি করেছে ১২টি দেশের মধ্যে। যে কারণে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগি এখন ভিয়েতনাম। টিপিপি চুক্তির ফলে দেশটি বিনা শুল্কে পোশাক রপ্তানির সুযোগ পেল। আর বাংলাদেশ আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে ১৬ শতাংশ শুল্ক দেবে। শুধু ভিয়েতনামই নয়; ১২টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ পাবে। তাই বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। এমনকি বাজার হারানোর আশংকাও রয়েছে। তাই সময় থাকতেই এসব বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে দুটি সুপারিশের কথা বলেছেন। প্রথমত, শর্তানুযায়ী ওবামা প্রশাসনের একশন প্ল্যান কিংবা শর্ত পুংখানুপংখভাবে বাস্তবায়ন। দ্বিতীয়ত দেশটির সঙ্গে টিকফা অনুযায়ী টিকফার প্ল্যাটফর্মের কার্যকর ব্যবহার করা। এছাড়া সবাইকে জিএসপি সুবিধা দেয়া হলো বাংলাদেশ ছাড়া। এ বিষয়ে মার্কিন সরকারকে স্বচ্ছতার সঙ্গে জানাতে হবে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থাটা কী।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, জিএসপি ফিরে পেতে হলে সরকারকে তাদের দেয়া সকল শর্ত পূরণ করতে হবে। সরকার যতই বলুক যে শর্ত পূরণ হয়েছে। যে পর্যন্ত য়ুক্তরাষ্ট্রের সন্তুষ্টি না আসবে ততোদিন পর্যন্ত আমরা জিএসপি পাব না। এজন্য শর্তপূরণের বাস্তবতা কি বা কতটুকু পূরণ হয়েছে সে দিকে নজর দিতে হবে। অযথা দৌড়ঝাঁপ করে লাভ হবে না। এজন্য অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তবে গত দুই তিন বছরে আমাদের পোশাকখাতের অনেক উন্নতি হয়েছে। তাদের দেয়া ১৬টি শর্ত সম্পূর্ণভাবে পূরণ করতে বাংলাদেশের আরও ২ বছর লেগে যাবে। তাই বলা যায় আগামী ২ বছর পর আমরা এভাবেই জিএসপি ফিরে পাব।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সংবাদকে বলেন, জিএসপি ইস্যুতে রাজনৈতিক কারণ থাকলেও আমাদের উচিৎ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোযোগ দেয়া। আমাদের স্বার্থেই অ্যাকর্ড অ্যালায়ন্স বা যুক্তরাষ্ট্র কি বলছে সেটা শুনে কাজ করতে হবে। যদিও জিএসপি আমাদের তেমন কোন কাজে আসে না। কিন্তু দেশের ভাবমূর্তির কথা বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। গত দুই বছরে আমাদের পোশাক খাতে যে উন্নতি হয়েছে সে বিষয়গুলো তাদেরকে ভালোভাবে বোঝাতে হবে। বায়রাদের কাছে যে খারাপ তথ্য গেছে সেটা দূর করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে যৌথ উদ্যোগে এগিয়ে আসতে হবে।বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশের জন্য জিএসপি স্থগিত হয়েছে ২০১৩ সালে। এরই মধ্যে প্রায় তিন বছর কেটে গেছে। এর ফলে যে ধরনের সমস্যার হওয়ার আশংকা ছিল তার ধাক্কা সামাল দেয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা নিজেদের তৈরি করে নিয়েছেন। ফলে জিএসপি ইস্যু বাংলাদেশের জন্য তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির মাত্র ২ শতাংশ পায় এই জিএসপি সুবিধা। আর তাই আর্থিক দিক থেকে বাংলাদেশকে তেমন কোন ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশংকা নেই। এখন প্রশ্ন হলো, ইমেজ সঙ্কট নিয়ে। ফলে জিএসপি মিললে আর্থিক সুবিধার চেয়ে বেশি লাভবান হওয়া যাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের ভাবমর্যাদা উন্নতির বিষয়ে।এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, জিএসপির জন্য সরকার সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমেরিকা দেয়নি। বাংলাদেশের শ্রম পরিবেশ জিএসপিপ্রাপ্ত অনেক দেশের চেয়ে ভালো। তবে জিএসপি না পাওয়ায় বাংলাদেশের যা আর্থিক ক্ষতি, তার চেয়ে বড় ক্ষতি আমাদের ইমেজের সংকট হচ্ছে। তবে আমরা আমেরিকা-বাংলাদেশের ব্যবসায়ী পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।এদিকে জিএসপি বাতিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনার ৯৮ থেকে ৯৯ ভাগই বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও দেশটি ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য জিএসপি সুবিধা চালু করলেও বাংলাদেশকে তা থেকে বঞ্চিত করেছে। শুধু রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা পায়নি। আমাদের আর কিছু করার নেই। এখন জিএসপি পাওয়ার জন্য আমি কোন উদ্যোগ নিতে রাজি নই।তবে সরকারের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেন বস্নুম বার্নিকাট, তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) হারানো বা পুনর্বহাল না করা রাজনৈতিক কোন ইস্যু নয়। যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত সব শর্ত পূরণ হয়নি বলেই বাংলাদেশ এখনও জিএসপি সুবিধা পায়নি। তবে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে বাংলাদেশকে যে ১৬টি শর্ত পূরণ করতে বলা হয়েছে; তা পূরণ করতে পারলে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।বিজিএমইএ এর সূত্র মতে, দেশের বেশিরভাগ গার্মেন্ট কারখানাতেই কমপ্লায়েন্ট বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিকল্প সিঁড়ি, শিশু শ্রমিক নিষিদ্ধ, নূ্যনতম ওয়েজ বাস্তবায়ন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সুরক্ষার জন্য কাজ করা হচ্ছে। সমপ্রতি অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শনে ৮ কারখানা ঝুঁকিপূর্ণসহ প্রায় অর্ধশতাধিক কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তারা। এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব পড়েছে এই খাতে। তবে কমপ্লায়েন্ট নিশ্চিত করার বিষয়ে উদ্যোগ থাকলেও জিএসপি সুবিধা পাওয়া রাজনৈতিক বিষয় বলে মনে করছেন সংগঠনটি।জানা গেছে, ১৯৭৬ সালে জিএসপি সুবিধা চালু হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এই সুবিধা পেয়ে আসছে। দোহা নীতি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭ শতাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে তাদের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা। বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এই সুবিধা দিয়েই রেখেছে। তবে যেসব পণ্য তাতে অন্তর্ভুক্ত আছে তার অধিকাংশই বাংলাদেশ রপ্তানি করে না। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক শিল্পের জন্য কোন জিএসপি সুবিধা দেয় না। বাংলাদেশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। বিপরীতে দেশটিতে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করছে। আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের পণ্যকে ঢুকতে হলে গড়ে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে হয়। অথচ ভারতের ক্ষেত্রে গড় শুল্কহার ২ দশমিক ২৯ শতাংশ, চীনের ক্ষেত্রে ৩ দশমিক ০৮ ও তুরস্কের ক্ষেত্রে তা ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। পাকিস্তানকে দিতে হয় ৩ শতাংশ আর ফ্রান্সকে দিতে হয় ১ শতাংশ। এ বছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক বাবদ প্রদান করেছে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে তার ৬ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বরং বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের যোগান দিচ্ছে।উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১১শ’র বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার পর, বাংলাদেশি কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় ইউরোপ ও আমেরিকার ব্র্যান্ডগুলোর সমন্বয়ে গঠিত দুটি জোট। একর্ড-এ স্বাক্ষরকারী ১৯২টি ব্র্যান্ডের কাছে পোশাক রপ্তানি করে এমন ১ হাজার ৫শ’ কারখানা পরীক্ষা ও সংস্কার কাজ তদারক করছে একর্ড। আগামী ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ সব কারখানার সংস্কার কাজ তদারক করতে একর্ড-এ স্বাক্ষরকারী ব্র্যান্ডগুলো চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। একর্ড ও এলায়েন্স-এর পরিদর্শনে ঝঁকিপূর্ণ বিবেচনায় ইতোমধ্যে প্রায় ৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।