যুক্তরাষ্ট্র যেসব শর্ত দিয়েছিল তার অনেকগুলোই পূরণ করেছে বাংলাদেশ গত দুই বছরে। সুতরাং এর ভিত্তিতেই জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দিতে পারত। জিএসপি সুবিধা না পাওয়ায় প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প হয়তো তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, কিন্তু যেসব পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত সেগুলো তো চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ শিল্পের কথা বিবেচনা করে হলেও জিএসপির স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া দরকার।
Published in Shokaler Khobor on Saturday, 3 October 2015.
‘জিএসপি দিলে দাও না দিলে না’ : প্রধানমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক
অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি ফিরে পেতে বাংলাদেশকে মোট ১৬ শর্ত দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত আড়াই বছরে শর্তের সবগুলোই পূরণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও ঝুলে আছে মার্কিন বাজারে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়া। গত আগস্টে পুনরায় ১২২ দেশকে জিএসপি সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ উপেক্ষিতই থেকে গেছে। জিএসপি ইস্যুটি আবারও আলোচনায় এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়া উপলক্ষে নিউইয়র্ক সফরের সময়। এ সফরে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে জিএসপি থেকে সবচেয়ে কম সুবিধা পেয়ে থাকলেও এটি আমাদের জন্য ইমেজের ব্যাপার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর থেকে অযৌক্তিকভাবে জিএসপি সুবিধা তুলে নিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ জিএসপি থেকে সবচেয়ে কম সুবিধা পেয়ে থাকে। তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশের এখন অবস্থান, জিএসপি দিলে দাও না দিলে না। তিনি আরও বলেন, ‘তারা আমাদের ১৬টি শর্ত দিয়েছিল। তা আমরা পূরণ করেছি। কম সুবিধাভোগী হিসেবে শর্ত দেওয়াটা অযৌক্তিক। তারপরও আমাদের পোশাক খাতে রফতানি ৩২ মিলিয়ন ইউএস ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও বলেছেন, ‘আমরা সব শর্ত পূরণ করার পরও জিএসপি ফিরে পাইনি। এটা অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু রাজনৈতিক কারণে আমরা তা পাইনি। জিএসপি ফিরে না পেলেও বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না।’স্থগিতাদেশের আগে জিএসপির আওতায় বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রফতানি করতে পারত। কিন্তু ২০১৩ সালের ২৭ জুন জিএসপি স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ তার আগের বছর ২০১২ সালে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জিএসপি সুবিধার আওতায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের তামাক, ক্রীড়া সরঞ্জাম, চিনামাটির তৈজসপত্র, চামড়া ও প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করেন। যাতে তারা শুল্ক ছাড় পান ২০ লাখ ডলারের মতো। জিএসপি ফিরে না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব শিল্প মালিকরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সকালের খবরকে বলেন, দোষ করল কারা আর শাস্তি পেতে হল কাদের। গার্মেন্ট সেক্টরের ভুলের কারণে আমরা কেন শাস্তি ভোগ করব। তা ছাড়া গত দুই বছর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া মাফিক আমরা অনেক কিছু করেছি। তারপরও ১২২ দেশকে জিএসপি সুবিধা দিলেও বাংলাদেশকে না দেওয়া খুবই দুঃখজনক। দেশটির এ সিদ্ধান্তে আমরা খুবই ক্ষুব্ধ।
আর অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, জিএসপি ফিরে না পাওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ইমেজের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সকালের খবরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কারখানায় কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকারের কথা বলে জিএসপি স্থগিত করেছে। কিন্তু যে ১২২ দেশকে পুনরায় জিএসপি সুবিধা দেওয়া হয়েছে সেসব দেশের কতটাতে শ্রম অধিকার ভালো রয়েছে এবং কারখানার কর্মপরিবেশ কেমন রয়েছে সেগুলোও দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যেসব শর্ত দিয়েছিল তার অনেকগুলোই পূরণ করেছে বাংলাদেশ গত দুই বছরে। সুতরাং এর ভিত্তিতেই জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দিতে পারত। জিএসপি সুবিধা না পাওয়ায় প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প হয়তো তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, কিন্তু যেসব পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত সেগুলো তো চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ শিল্পের কথা বিবেচনা করে হলেও জিএসপির স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া দরকার।
জানা গেছে, ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পেয়ে আসছিল। কিন্তু বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকার এবং শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না অভিযোগ এনে ২০১৩ সালের ২৭ জুন জিএসপি সুবিধা বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ১৬টি শর্ত দেয় এবং কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেয়।
ওবামা প্রশাসনের দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, আমিনুল হত্যাকাণ্ডের বিচার করা, ২০০ কল-কারখানার পরিদর্শক নিয়োগ, চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (সিডিএ) পুনর্গঠনের আওতায় ৩২ জন পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স (এফএসসিডি) পুনর্গঠনের আওতায় ২৬০ জন পরিদর্শক নিয়োগ, শিল্প এলাকায় সাতটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পরিদর্শকের চলমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, আইএলওর সহযোগিতায় ওয়েবসাইটভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরি, সংশোধিত শ্রম আইনের একক মৌলিক ইংরেজি অনুবাদ প্রাপ্তি নিশ্চিত, বিসিডব্লিউএস এবং সেফের নিবন্ধন ও পুনর্নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়া, বিদ্যমান শ্রম আইন ইপিজেডে প্রয়োগ, চিংড়ি খাতে শ্রমিকদের সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি। ইতোমধ্যেই এসব শর্ত পূরণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি আবার চালু করা হলেও বাংলাদেশের নাম নেই নতুন তালিকায়। অথচ দুই বছরের জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ স্কিম জেনারেলাইজ সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা ১২২টি দেশ ও অঞ্চলকে নতুনভাবে প্রদান করা হয়েছে। চলতি বছরের ২৯ জুলাই থেকে মার্কিন বাজারে এই সুবিধা কার্যকরও করা হয়েছে। কিন্তু নতুনভাবে চালু হওয়া জিএসপি স্কিমে নাম নেই, এ সুবিধার ওপর ইতোপূর্বে স্থগিতাদেশ পাওয়া বাংলাদেশের। জিএসপি পুনর্বহাল সংক্রান্ত এই তথ্য গত আগস্টে দেশটির বাণিজ্য দফতর ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইউএসটিআর) নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জিএসপি ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে ইউএসটিআর-এ আবার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এ শুনানিতে বাংলাদেশের ওপর থেকে জিএসপি স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।