Published in Jaijaidin on Sunday, 9 August 2015.
বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমার সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর সারাবিশ্বে কমে আসবে জীবনযাত্রার ব্যয়। ২০১৪ সালের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার বাজারে কমে আসবে জ্বালানি ও ধাতব পণ্যের চাহিদা
মেসবাহুল হক
বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমলেও এর সুফল পাচ্ছে না এ দেশের সাধারণ ক্রেতারা। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে যে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তার প্রভাব বাজারে দেখা যায় সঙ্গে সঙ্গে_ এমন পর্যবেক্ষণ অর্থনীতিবিদদের।
এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে বাজারে অসাধু সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট রোধে প্রতিযোগিতামূলক আইন যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি বাস্তবতার ভিত্তিতে টিসিবিকে কার্যকর করা, গণপরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনা এবং দ্রব্যমূল্য জনগণের হাতের নাগালে রাখতে জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরেই কমে আসবে জীবনযাত্রার ব্যয়। ২০১৪ সালের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার বাজারে কমে আসবে জ্বালানি ও ধাতব পণ্যের চাহিদা। নিয়ন্ত্রণে থাকবে বিশ্ব মূল্যস্ফীতিও। আর বাংলাদেশের জন্য সুখবর, চলতি বছরে শুধু তেল, গ্যাস ও কয়লার দামই কমবে প্রায় ৩৯ শতাংশ। নিয়ন্ত্রণে থাকবে চাল, ভোজ্যতেল ও গমের সরবরাহ। সংস্থাটির দাবি, প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৫৭ ডলারের নিচে নেমে আসতে সময় লাগবে আর মাত্র তিন মাস।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) পরিচালিত দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বিষয়ক প্রতিবেদনে গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে পণ্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর এর প্রভাবে ভোক্তার সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। ক্যাব বলছে, বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য ক্রমন্বয়ে কমলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে তার প্রভাব পড়ছে না। ফলে দেশে এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভোক্তারা।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভোক্তাদের নিত্যপণ্যের তালিকায় থাকা পণ্যের দাম এবং সেবার গুরুত্বের ভিত্তিতে জীবনযাত্রা ব্যয়ের এই হিসাব করা হয়েছে। অবশ্য এর মধ্যে শিক্ষা, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যয় ধরা হয়নি। সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছিল ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ১১ শতাংশ। কিন্তু এবার পণ্য ও সেবার মূল্য ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ বাড়ার পরও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।
ক্যাব বলছে, সরকার এবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ওয়াসার পানির দাম বাড়িয়েছে ৫ শতাংশের বেশি। তবে গ্যাসের দাম অপরিবর্তিত ছিল। তবে গত বছর বেশি বেড়েছে আদার দাম। আমদানি করা আদার দাম বেড়েছে ৫৩ দশমিক ৪০ শতাংশ ও দেশি আদা ৩৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া চালের দাম ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ, শাকসবজিতে ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, মোরগ-মুরগিতে ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ, গুঁড়া দুধে ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ, তরল দুধে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ, মাছে ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, সাবানে ৩ শতাংশ, পানসুপারিতে ৩ শতাংশ, ডালডায় ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া দেশি থান কাপড়ে দাম ৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ, শাড়িতে ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং গেঞ্জি তোয়ালে ও গামছায় ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও জ্বালানিবহির্ভূত উভয় পণ্যের দাম কম থাকাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশ ভোগ্যপণ্যের নিট আমদানিকারক দেশ। এখানের জিনিসপত্রের দাম অনেকটাই আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বিশেষত জ্বালানি তেলের মূল্য কম থাকলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হবে। আবার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম আগের তুলনায় সাশ্রয়ী হলে তা উৎপাদন খরচ কমাবে। উৎপাদন ও বিনিয়োগের খরচ কমলে তা মূল্যস্ফীতি কমাবে।
তাহলে বাজারে পণ্যের দাম কমছে না কেন?_ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাজারব্যবস্থায় ভুল আছে। এগুলো শুধরে নিলেই বাজার স্বাভাবিক গতিতে চলবে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। জ্বালানি তেলে মূল্যহ্রাসের কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেশের বাজারে পড়েনি। ভোগ্যপণ্যের বাজার চলছে উল্টো গতিতে। বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের ভেতর বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। একটি প্রতিযোগী কমিশন গঠন করার কথা থাকলেও এটি আটকে আছে। প্রতিযোগী আইনের অধীনে এই কমিশন গঠন করার কথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। দেশে কোনো প্রতিযোগী কমিশন না থাকায় খাদ্যপণ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের বাজার মনিটরিং সঠিকভাবে করা হচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের মনিটরিং করা হলেও আইন ও কমিশনের অভাবে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশে যে সাপ্লাই চেনগুলো কাজ করে, আসলে সেগুলো গুটিকয়েক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই দেশের বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণ ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করে। তিনি আরো বলেন, পণ্য বিপণন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ছাড়া এর সুফল কখনোই পাবেন না সাধারণ জনগণ।
এদিকে, শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ানবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, অন্যবারের তুলনায় এবার বৃষ্টির পরিমাণ বেশি। আর বৃষ্টির পানি ও বন্যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অনেক শাকসবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। আর এ কারণে দেশের কাঁচাবাজারে পণ্যের দর বাড়তি।
পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা জানান, কিছুদিন আগে অর্থাৎ জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে ভারতে অনেক জায়গায় বন্যা হয়েছে। সেই বন্যার পানিতে অনেক ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। যার মধ্যে পেঁয়াজের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণে দেশে ভারতীয় পেঁয়াজের বাজার ঊর্ধ্বমুখী।
এছাড়া সেই সময় যেসব ব্যবসায়ী মালামাল মজুদ রেখেছিলেন, বন্যার অজুহাতে তারা অতিরিক্ত দামে সেগুলো বিক্রি করে মুনাফা করছেন। আগামী ঈদের আগে পেঁয়াজের দাম তেমন কমার সম্ভাবনা নেই বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
শনিবার কারওয়ানবাজারের খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়, ভারতীয় বড় পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬২ টাকায়, ছোট পেঁয়াজ ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতিকেজি দেশি রসুন ৬০ টাকায়, ভারত থেকে আমদানি করা রসুন ১০০ টাকায় বিক্রি হয়।
কারওয়ানবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী লাকসাম বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী মো. হাবিবুর রহমান মোস্তফা জানান, কিছুদিন আগের ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর তখন দেশের বাজারে পেঁয়াজের দর বাড়িয়ে দিয়েছে আমদানিকারকরা। যদিও সে সময় তাদের হাতে বন্যার আগেই আমদানি করা পেঁয়াজ ছিল। তারা তখন পেঁয়াজের দর না বাড়ালেও পারত। কিন্তু বন্যার অজুহাতে তারা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করেছে। বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম আসলে বাড়তি, তাই বাজারে বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অপর পেঁয়াজ ব্যবসায়ী খাজা অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী লোকমান হোসেন জানান, পেঁয়াজের বাজারে ভারতের বন্যার রেশ এখনো রয়ে গেছে। আর এতে আগামী ঈদের আগে বাজারে পেঁয়াজের দাম কমবে বলে মনে হচ্ছে না।
গতকাল কারওয়ানবাজার, সেগুনবাগিচা, শান্তিনগর খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, মানভেদে প্রতিকেজি লাল লম্বা বেগুন ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়, সাদা গোলাকার বেগুন ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়, মরিচ ৯০ থেকে ১০০ টাকায়, শসা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়, গাজর ৫০ থেকে ৬০ টাকায়, ধনিয়া পাতা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, পেঁপে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, টমেটো ৮০ থেকে ১০০ টাকায়, করলা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, ঢেঁড়স ৫০ থেকে ৬০ টাকায়, কাঁকরোল ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়, ঝিঙা ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়, সাদা গোলআলু ২৪ টাকায়, লাল গোলআলু ২৫ টাকায়, ধুন্দল ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়, কচুর ছড়ি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়, মুলা ৩৫ থেকে ৪৫ টাকায়, বরবটি ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়, কহি ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়, পটোল ৫০ থেকে ৬০ টাকায়, গাজর ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়, কচুর লতি ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, শিম ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে, খুচরা বাজারে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি সাদা ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায় ও লাল মুরগি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হয় ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায়।
বাজারে ডিমের দাম বেড়েছে। প্রতি হালি ব্রয়লার মুরগির লাল ডিমের পাইকারি দাম ৩৫ থেকে ৩৬, যা খুচরা বাজারে ৪০ থেকে ৪২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। হাঁসের ডিম প্রতি হালি ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা, যা পাইকারি বাজারে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়।