Published in Bonik Barta on Saturday, 28 June 2014.
দেশের উন্নয়নে তাঁর অবদান স্মরণীয়
মোস্তাফিজুর রহমান
গত ২৮ মে প্রখ্যাত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এম রহমতউল্লাহ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে, আক্ষরিক অর্থেই তা পূরণ হবার নয়। বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া ও বৃহত্তর এশীয় অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার নৈকট্য স্থাপনের বহুমুখী প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের সঙ্গে চার দশক ধরে ড. রহমতউল্লাহর নাম ছিল অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত। ব্যক্তি ড. রহমতউল্লাহর মৃত্যু যেমন আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক, তেমনি যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. রহমতউল্লাহর মৃত্যুও আমাদের জন্য অপূরণীয় অনুপস্থিতি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দেশের মধ্যকার আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, জ্বালানিসাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশ, যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ— এমনি বহুমাত্রিক বিষয়ে তাঁর বিস্তৃত জ্ঞানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন যথোপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে। দক্ষিণ এশিয়া ও বৃহত্তর এশীয় অঞ্চলের যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে বাংলাদেশের স্বার্থ, গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও অংশীদারিত্ব যাতে নিশ্চিত থাকে, সে বিষয়ে সবসময় তিনি ছিলেন সজাগ ও সচেতন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধকতাবিহীন ও আধুনিক আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অপরিহার্যতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশের পণ্য ও সেবা খাতের রফতানি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অনেকের আগে তিনি এ নিয়ে ভেবেছেন, গবেষণা করেছেন, লিখেছেন, কথা বলেছেন। এসব বিষয়ে তাঁর অগ্রাভিমুখী ভাবনা, দূরদৃষ্টি ও মূল্যবান অবদানের জন্য আমরা তাঁর কাছে সব সময়ই ঋণী থাকব। যথার্থ অর্থেই এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন অগ্রপথিক।
মেধার স্বাক্ষর ড. রহমতউল্লাহ রেখে গেছেন তাঁর কৃতি ছাত্রজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বুয়েটেরই শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে তিনি চলে যান যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখান থেকে ১৯৬৬ সালে ‘মাস্টার্স অব সিভিক ডিজাইন’ এবং ১৯৬৮ সালে ‘ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানিং’-এর ওপর পিএইচডি করেন। বুয়েটে ১৯৬৮ সালে ‘আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং’ বিভাগের যাত্রা হলে তিনি এ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে যোগ দেন। এরপর চলে যান বাংলাদেশ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে, যেখানে তিনি কর্মরত ছিলেন অবকাঠামো ও যোগাযোগ বিভাগের জয়েন্ট চিফ হিসেবে। কর্মজীবনের পরবর্তী ধাপে তিনি যোগদান করেন জাতিসংঘের ‘ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ (এসকাপ)-এ যেখানে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০০ সালে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এসকাপে কর্মরত অবস্থায় এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মূল্যবান অবদান রাখেন। এ সময় এশিয়ান হাইওয়ে ও রেল নেটওয়ার্কের রুট-নির্ধারণ, এক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রয়োজনীয়তা, অর্থায়নের সম্ভাব্য উত্স অনুসন্ধান এবং এসব রুটের বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নসহ বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।
এসকাপ থেকে অবসর গ্রহণের পর যোগাযোগ বিষয়ে তাঁর সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করতে অধ্যাপক রেহমান সোবহান ড. রহমতউল্লাহকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ও উত্সাহিত করেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের আগ্রহে তিনি সিপিডি কর্তৃক পরিচালিত অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন-সম্পর্কিত গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হন এবং এতে নেতৃত্ব দেন। ২০০১ সালে সিপিডি যখন বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর উন্নয়নের লক্ষ্যে নীতি-সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১৬টি টাস্কফোর্স গঠন করে, তখন তিনি যোগাযোগ-সম্পর্কিত টাস্কফোর্সের সদস্য-সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৩ সালে এসব নীতি-সুপারিশ বাস্তবায়ন মূল্যায়নের লক্ষ্যে যখন আবার নতুন করে ১৭টি টাস্কফোর্স গঠিত হয়, তখনো তিনি যোগাযোগ-সম্পর্কিত টাস্কফোর্সের সদস্য-সচিবের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। এ সময়কালে সার্ক অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন। ঢাকা ও রাজশাহীর যোগাযোগ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সার্কের আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রকল্পে তিনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে অবদান রাখেন। বিশ্বব্যাংক ও ডিএফআইডির পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ২০০৯ সালে তত্কালীন নবনির্বাচিত সরকার যখন ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন ও উন্নয়নে উদ্যোগ নেয় এবং এ বিষয়ে কৌশল ও নীতি-সুপারিশ প্রণয়নের জন্য জাতীয় কমিটি গঠন করে, তখন পাঁচটি উপকমিটির একটির আহ্বায়ক হিসেবে স্থল, জল ও রেল রুট নির্ধারণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিকল্প কী হতে পারে তা নির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে তাঁর আগ্রহ ছিল গভীর। স্মর্তব্য যে, ১৯৯৯ সালে বিসিআইএম ফোরাম গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে পরে গবেষণাকর্ম পরিচালনা, বিসিআইএম ফোরামগুলোর আয়োজনসহ সিপিডি যেসব বিভিন্নমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে, সেগুলোর প্রতিটিতে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ২০১৩ সালের প্রথম দিকে কলকাতা থেকে কুনমিং পর্যন্ত যে কার শোভাযাত্রা হয়, তাঁর আয়োজনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন, সিপিডির সংশ্লিষ্ট-কর্মকাণ্ডে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ড. রহমতউল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক ও পরোপকারী একজন মানুূষ। যারাই তাঁর সঙ্গে মিশেছেন, তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি মানুষকে কাছে টেনেছেন, তাঁর ব্যবহারে অন্যরা তাকে কাছে পেতে চেয়েছেন। সিপিডির সিনিয়র ফেলো ড. রহমতউল্লাহ ছিলেন সিপিডি পরিবারের একজন একান্ত আপনজন, অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বিশেষ স্নেহভাজন।
শেষের কয়েক বছর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও তাঁর মুখ থেকে প্রাণবন্ত হাসি কখনো হারিয়ে যায়নি। ড. দেবপ্রিয় ও আমি যখন শেষ বিদায়ের আগে তাকে হাসপাতালে দেখতে যাই, তখনো তাঁর মুখে দেখেছি সেই অমলিন প্রশান্ত ভাব। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তাঁর অত্যন্ত আদরের তিন কন্যা ও তাদের পরিবার এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
একদিন দক্ষিণ এশিয়া ও বৃহত্তর এশীয় অঞ্চলের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ অবকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে হবে সব গতিপথের সম্মিলনী ভূমি, মধ্যমণি। সড়ক, রেল আর নৌ-পথের নিরবচ্ছিন্ন গতিধারা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রসার, উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম দিকে ধাবমান যানবাহন, মানুষের সঙ্গে মানুষের নৈকট্য— এসবের কল্যাণে আমাদের দেশের অর্থনীতি গভীরভাবে উপকৃত হবে। আমাদের দেশের জনগণের অভূতপূর্ব সেই আর্থসামাজিক উন্নয়নে তাঁর গুরুত্ব হবে অপরিসীম। অনাগত সেদিনে ড. রহমতউল্লাহকে আমাদের আরো বেশি করে মনে পড়বে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)