Published in দৈনিক সমকাল on Sunday, 29 May 2016
জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছেই
মোস্তফা তাহান
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরেও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে লাগামহীনভাবে। চলতি অর্থবছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি বেড়েছে বাসাভাড়া, পরিবহন ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে ব্যয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বেড়েছে। কিন্তু বিনিয়োগ স্থবিরতায় চলতি অর্থবছরে মানুষের আয় তেমন বাড়েনি। ফলে জীবনযাত্রার মানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ শতাংশ হারে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০১৫ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার পর কিছু না কিছু পণ্যের দাম বাড়ে। আগামী অর্থবছরে ব্যাপকভাবে ভ্যাটের আওতা বাড়ায় পণ্যমূল্য আরও এক দফা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তখন জীবনযাত্রার মান আরও এক দফা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত জুলাইয়ে ২০৭ টাকা ৫৮ পয়সা দিয়ে সে সেবা ও পণ্য পাওয়া যেত গত এপ্রিলে তা পেতে ব্যয় করতে হয়েছে ২২৩ টাকা ৩৭ পয়সা। শতকরা হিসাবে দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৬১ ভাগ। এর আগের অর্থবছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এদিকে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সংগ্রহীত ঢাকা শহরের ১৫টি বাজার ও বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা সার্ভিসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে শতকরা ৬ দশমিক ৩৮ ভাগ এবং পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে শতকরা ৪ দশমিক ৮১ ভাগ। ২০১৪ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১৫ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ২০১৪ সালের চেয়ে শূন্য দশমিক ৪৪ পয়েন্ট বেশি বেড়েছে।
গত অর্থবছরের শুরু থেকেই পণ্যমূল্য এক দফা বেড়েছে। এরপর গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে প্রায় সবকিছুর দাম আরও এক দফা বেড়েছে। ডিসেম্বরে এসে ডলারের দাম প্রায় ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে আরও এক দফা। গত জানুয়ারি থেকে শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে লাগামহীনভাবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার পর গত শীত মৌসুমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম খুব একটা কমেনি। শীতের পর থেকে পণ্যের দাম আবার হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে।
আলোচ্য সময়ে জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে বাড়েনি মানুষের আয়। ফলে অনেক কিছুর সঙ্গে আপস করে, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে।
সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছরের ২৮ মে থেকে এ বছরের ২৮ মে পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমায় আটার দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১১ শতাংশ। ওই সময় বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম কমলেও খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে সামান্য। তবে পাম অয়েলের দাম ১০ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ছোলার দাম বেড়েছে ৪৮ শতাংশ, অন্যান্য ডালের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেখা যায়, গত এপ্রিল পর্যন্ত খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তবে খাদ্যপণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে কম বেড়েছে। গত অর্থবছরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। গত এপ্রিলে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত এপ্রিলে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ওই সময় প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার কীভাবে কমেছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির হার নিরূপণে সবচেয়ে বেশি ওয়েট দেওয়া হয়েছে চাল-ডাল, ভোজ্য তেল ও মাছ-মাংসের মধ্যে। এসব পণ্যের দাম ওই সময় বেড়েছে। তার পরও কীভাবে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার কমল। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম শহরের পাশাপাশি গ্রামেও বেড়েছে।
এ বিষয়ে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতির হার নিরূপণের যে পদ্ধতি রয়েছে, তাতে ওয়েট দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা উচিত। কেননা সেই আগের মতো করে এখন আর চলে না। আধুনিক জীবনযাত্রায় অনেক কিছুইর পরিবর্তন হয়েছে।
তিনি বলেন, জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হলে আগে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মানুষের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এটি হলে উৎপাদন বাড়বে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। তখন মূল্যস্ফীতির আঘাত এমনিতেই মানুষ সহ্য করতে পারবে।