Published in আমাদের সময় on Wednesday, 8 June 2016
অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হবে দেড় লাখ কোটি টাকা
রুমানা রাখি
রোজা ও ঈদে মানুষের চাহিদা বাড়ে। এই চাহিদা মেটাতে করে কেনাকাটা। এই কেনাকাটার বাড়তি অর্থের জোগান দিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের দিচ্ছে ঈদ-বোনাস। কোনো-কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ৩-৪টি পর্যন্ত বোনাস দিচ্ছে। এর বাইরে বিশেষ ভাতা তো আছেই। এই সময়ে চাহিদার কারণে কোম্পানিগুলোও পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। এ জন্য বেড়ে যায় কাজের মাত্রাও। রোজার ঈদ সামনে রেখে বেশিরভাগ মানুষের চলে পুরো বছরের পোশাক ও অন্য সামগ্রীর কেনাকাটা। এসব কারণে ঈদ কেন্দ্র করে ব্যবসায়িক কর্মকা- বেড়ে যায় প্রায় দ্বিগুণ। এ কারণে বেড়ে যায় টাকার প্রবাহ। ঈদের বাড়তি ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে মানুষ ব্যাংক থেকে আগের সঞ্চয় তুলে এই সময়ে খরচ করে। এ কারণে ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ কমে যায়, বেড়ে যায় মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ। এ ছাড়া প্রবাসীরা দেশে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনের কাছে বেশি রেমিট্যান্স পাঠায় বাড়তি খরচ মেটাতে। এসব মিলে টাকার চলাচল বাড়ায় একদিকে যেমন অর্থনীতি চাঙ্গা হয়, তেমনি নগদ টাকার প্রবাহে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। এসব মিলে রোজা ও ঈদ কেন্দ্র করে এক মাসে বাজারে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বাড়তি জোগান আসে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রোজার ঈদ দেশের সব থেকে বড় উৎসব। এই ঈদে মানুষ পোশাক-পরিচ্ছদ, জুতা, গৃহসামগ্রীসহ চাহিদার প্রায় সব পণ্যই কিনে থাকে। এ ছাড়া বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়জস্বনের মধ্যে উপহার দেওয়ার একটি প্রবণতাও এ ঈদে চলে। এসব মিলে এই সময়ে দেশি শিল্প চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সারা দেশ থেকে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ভিড় করেন বড়-বড় আড়তে। ফলে সার্বিকভাবে টাকার লেনদেন বেড়ে যায়। ফলে বেড়ে যায় অর্থনৈতিক কর্মকা-। দেশের পোশাক, ক্ষুদ্র, ভোগ্যপণ্য, পাইকারি ব্যবসায়ী, উৎপাদক পর্যন্ত এই সময়ে টাকার প্রবাহ বাড়ে। এ কারণে বাড়তি টাকার জোগান দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।
রোজা ও ঈদ উৎসবের অর্থনীতি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের এক সমীক্ষায় বলা হয়, এ সময় ইফতার ও সেহরি উৎসবে যোগ হচ্ছে ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। পোশাকের বাজারে যোগ হচ্ছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। রমজান ও ঈদে অ্যাপায়ন বাবদ অর্থাৎ ভোগ্যপণ্যের বাজারে বাড়তি যোগ হচ্ছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। ধনী মানুষের দেওয়া জাকাত ও ফিতরা বাবদ আসছে ৬০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। পরিবহন খাতে অতিরিক্ত যাচ্ছে ৬০০ কোটি টাকা। ঈদ কেন্দ্র করে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় ৪ হাজার কোটি টাকা। এসব খাতে নিয়মিত প্রবাহের বাইরে অতিরিক্ত যোগ হচ্ছে এক লাখ ২৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
এর বাইরে আরও কয়েকটি খাতের কর্মকা- অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সাড়ে ২০ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সম্ভাব্য বোনাস বাবদ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা, দেশব্যাপী ৬০ লাখ দোকান কর্মচারীর বোনাস ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের সম্ভাব্য বোনাস ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা ঈদ অর্থনীতিতে বাড়তি আসছে। এ ছাড়া আরও রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ঈদের সময়ে প্রবাসীরা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে বাড়তি ব্যয় মেটাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে থাকেন। এ হিসাবে আরও বাড়তি আসছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এসব মিলে ঈদ-বাজারে বাড়তি যোগ হচ্ছে দেড় লাখ কোটি টাকা।
ঈদুল ফিতর কেন্দ্র করে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ঈদকেন্দ্রিক এই অর্থনীতির আকার দেড় থেকে ২ লাখ কোটি টাকা। এই সময়ে বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য, কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসা, বড় প্রতিষ্ঠান, উৎপাদক প্রায় সব খাতই চাঙ্গা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাঙ্গা হয় দেশের তাঁতশিল্প।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, মানুষের চাহিদার বৈচিত্র্য এসেছে, সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে আয়। ঠিক তেমনি মানুষের ভোগ্যপণ্যের চাহিদায়ও বৈচিত্র্য এসেছে। ঈদের অর্থনৈতিক কর্মকা- এত দিন পোশাক আর জুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন মানুষ ইলেকট্রনিক পণ্য যেমন কিনছে, তেমনি উপহার দিচ্ছে। আবার অনলাইনে ব্যবসা (ই-বিজনেস) বেড়েছে, এমনকি দেশে-বিদেশে ভ্রমণেও যাচ্ছে। তাই স্বল্প সময় হলেও অর্থনীতির কিছুটা হলেও চাঙ্গা হয় বলে মনে করেন তিনি। ঈদে অর্থনীতির আকার যা-ই হোক না কেন, দেশের ভেতরে এর মূল্য সংযোজন কতটুকু, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক পণ্যই এ উপলক্ষে আমদানি হয়। তবে ঈদ ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বিস্তৃতি ঘটায় শহর ও গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। যার ফলে মানুষ কর্মমুখী হয়।
এফবিসিসিআইয়ের ২০১৫ সালের ঈদের বাজারের জরিপ অনুযায়ী, ঈদুল ফিতরের উৎসব ঘিরে ঈদ-বাজারে লেনদেন হয় ৩২ হাজার কোটি টাকা। ওই হিসাবে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে ১ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। শুধু রোজায় বাজারে আসছে অতিরিক্ত ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। তবে গত বছরের তুলনায় এবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কারণে এই টাকার পরিমাণ হতে পারে এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩২ হাজার কোটি টাকাই পোশাক খাতে ব্যয় হবে। বাড়তি অর্থের প্রায় সাড়ে ২৫ শতাংশই খরচ হচ্ছে পোশাক খাতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পাল আমাদের সময়কে জানান, অর্থনীতির দুই ধরনের শক থাকে। ঈদ ঘিরে অর্থনীতিতে টাকার যে প্রবাহ থাকে তা হচ্ছে পজিটিভ শক। এই সময় অর্থনৈতিক লেনদেন অনেক বেশি হয়। তা ছাড়া ঈদ ঘিরে রেমিট্যান্সও বেশি আসে। তাই অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের চাহিদার প্রয়োজনীয়তার কারণে অধিক পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তিনি আরও বলেন, এর প্রভাবে যে মূল্যস্ফীতি বাড়ে তা ইতিবাচকই হয়। কেননা এই সময়ে বাড়তি কর্মসংস্থানের কারণে মানুষের আয় যেভাবে বাড়ে সে তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার থাকে খুবই কম।
ব্যবসায়ীরা জানান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে গত বছরের তুলনায় এবার ঈদ কেনাকটা বাড়বে ১০-১৫ শতাংশ। এরই মধ্যে পাইকারি বাজার থেকে অন্যান্য বাজারে পণ্য গত বছরের এই সময়ের তুলনায় পণ্যের সরবরাহ বেশি নেওয়া হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় দাম বৃদ্ধির হার ১০-২০ বেশি।
সার্বিকভাবে ঈদ-ব্যবসা নিয়ে এফবিসিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ঈদ ঘিরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি অনেক চাঙ্গা থাকে। তাই এবার স্থিতিশীল অর্থনীতির প্রভাব দেশের বাজারে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।