Published in দৈনিক ইত্তেফাক on Saturday, 16 July 2016
বাংলাদেশের জিএসপি সনদে পণ্য রপ্তানি চীন-ইন্দোনেশিয়ার!
আস্থা হারাচ্ছে ইউরোপ, নতুন শর্ত আরোপের শঙ্কা
বাংলাদেশের জিএসপি সনদ নিয়ে ফের বড় আকারের জালিয়াতি হয়েছে। ইউরোপে পণ্য রপ্তানির বিপরীতে এ রকম ২৩৬টি সন্দেহজনক জিএসপি সনদের ৩৩২টিই ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা চালানের মাত্র চারটি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নামে রপ্তানি দেখানো হলেও এসব সনদের বিপরীতে মূলত চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পণ্য রপ্তানি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এ সনদ কীভাবে তৃতীয় দেশের রপ্তানির হাতিয়ার হলো, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এখন সেটি খোঁজার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় কমিশনের দুর্নীতি তদন্তকারী অফিস ওলাফের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে এটি খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় ৩০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গেও বৈঠক করেছে তারা। ইস্যুটি নিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে ইপিবি’র পক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হচ্ছে, এ অপকর্মের সঙ্গে ইপিবি জড়িত নয়। এসব জিএসপি সনদ বেহাত হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী সংগঠনের অসাধু কর্মী ছাড়াও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তা (কমার্শিয়াল) জড়িত থাকতে পারে মনে করছেন ইপিবি’র ভাইস চেয়ারম্যান মাফরুহা সুলতানা।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপের দেশগুলোতে অস্ত্র বাদে সব ধরনের পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এটি জিএসপি (জেনারেলাইজড স্কিম অব প্রেফারেন্সেস) নামে পরিচিত। তবে পণ্যটি প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশে তৈরি হয়ে রপ্তানি হচ্ছে কিনা, তা যাচাই করে সনদ দেয় ইপিবি। এটিকে বলা হয় জিএসপি সনদ। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশই এখন ইউরোপের দেশগুলোতে যায়। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় না থাকায় চীন বা ইন্দোনেশিয়া ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের ন্যায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। কিন্তু এসব দেশের কিছু রপ্তানিকারক একই সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের জিএসপি সনদ দিয়ে এদেশেরই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে রপ্তানি করছে।
জানা গেছে, গত কয়েক মাসে এমন ২৩৬টি সন্দেহজনক চালান আটক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৭টি দেশের শুল্ক কর্তৃপক্ষ। ওলাফের তদন্তে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, চীন বা ইন্দোনেশিয়ার পণ্য সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়া হয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি হয়েছে। কোম্পানির নাম, জিএসপি সনদ দেখে সন্দেহ হলে এসব চালান আটক রেখে উত্স দেশ যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওলাফকে। এর অংশ হিসেবে সিনিয়র তদন্ত কর্মকর্তা মাইকেল ডিটরিচের নেতৃত্বে ওলাফের ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল গত ১৫ মে ঢাকা সফরে আসে। সন্দেহজনক রপ্তানি চালানে বাংলাদেশের যে সব কোম্পানির নাম ব্যবহার করা হয়েছে সে সব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন ওলাফ কর্মকর্তারা।
তাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও ব্যবসায়িক পরিচিতি নম্বর (বিন) ব্যবহার করে এ অপকর্ম করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে মিল থাকলেও বিন নম্বর ভুয়া। আবার নাম, ঠিকানা ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু যে সনদ ব্যবহার করে এ রপ্তানি করা হয়েছে, তা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়া।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম করে ২৮টি জিএসপি সনদের বিপরীতে ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডে বাইসাইকেল রপ্তানি হয়েছে। যাচাইকালে দেখা যায়, ২৮টি জিএসপি সনদের সবই ভুয়া। রপ্তানিকারক মোস্তফা ট্রেড কোম্পানি নামক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই নেই। আরেক রপ্তানিকারক প্রিমিয়ার নামে কোনো কোম্পানিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আলিটা ও ইউনিগ্লোরি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের ৭টি সনদ অপব্যবহার করা হয়। অর্থাত্ এ ২৮টি সনদের বিপরীতে কোনো বাইসাইকেলই বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা হয়নি। এসব বাইসাইকেল চীন কিংবা ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার বন্দর হয়ে ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে বলে ওলাফ মনে করছে। অবশ্য এ বিষয়ে ফের অধিকতর তদন্ত করা হবে।
ইপিবি সূত্র জানিয়েছে, বাইসাইকেল ছাড়াও সিরামিক টেবিলওয়্যার, গ্লাস ফাইবার, ম্যাশ ফ্যাব্রিকসহ কিছু তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও জিএসপি সনদ জালিয়াতি হয়েছে। যে সব প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে জিএসপি সনদ জালিয়াতি হয়েছে, এমন তালিকায় রয়েছে চট্টগ্রামের মেরিমকো নামে স্যুট তৈরিকারক একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। প্রতিষ্ঠানটির নাম ব্যবহার করা হলেও ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। মন্নু সিরামিকের নাম ব্যবহার করেও রপ্তানি করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির যে ব্যবসায়িক শনাক্তকরণ নম্বর (বিন) দেওয়া হয়েছে, সেটি ভুয়া। এভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সোনালি আঁশ, জিএমএস গ্লাস, ম্যাক্সিম ব্রাইট, আর এস কর্পোরেশনসহ আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের নাম।
এছাড়া সন্দেহের তালিকায় থাকা রপ্তানিকারকদের মধ্যে ১৭টি পোশাক খাতের বলে চিহ্নিত হয়েছে। এসব কারখানার একটি তালিকা বিজিএমইএকে দিয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে ইপিবিকে জানাতে বলা হয়। ইপিবি সূত্র জানিয়েছে, জবাবে বিজিএমইএ জানিয়েছে, ১৭টি প্রতিষ্ঠানই প্রকৃত রপ্তানিকারক। জালিয়াতির কোনো দায় এসব প্রতিষ্ঠানের নেই।
তবে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মাফরুহা সুলতানা বলেন, বিজিএমইএ হয়তো প্রকৃত তথ্য জানে না। ওই সব প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়া সনদে হয়তো অন্য দেশ রপ্তানি করেছে। তিনি বলেন, এতে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কিন্তু এসব সনদ জালিয়াতির পেছনে ইপিবি’র দায় নেই। কিছু সনদ বিজিএমইএ-বিকেএমইএ’র কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায়, দায়ী রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কিছু মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে (কমার্শিয়াল অফিসার) অপব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, কোন কোম্পানির নামে, কোথা থেকে এসব সনদের মাধ্যমে রপ্তানি হলো, সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে কিছু চিহ্নিত করা হয়েছে। দায়ী কোম্পানিকে জরিমানা করা হয়েছে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে একের পর এক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের নামে জিএসপি সনদ জালিয়াতির ঘটনা ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের সম্পর্কে আস্থাহীনতা তৈরি করতে পারে। যে কোনো রপ্তানিকারকই তাদের সন্দেহের তালিকায় পড়বে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইত্তেফাককে বলেন, এসব কারণে ইউরোপ শুল্কমুক্ত রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন শর্ত আরোপ করতে পারে। নতুন নিয়ম ও প্রক্রিয়াগত জটিলতাও তৈরি হতে পারে। তিনি মনে করেন, জিএসপি সনদ জালিয়াতির পেছনে একটি চক্র জড়িত। আর জিএসপি সনদ বিতরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিদ্যমান ত্রুটির সুবিধা নিচ্ছে চক্রটি। ইস্যুটিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। ইপিবিসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।