Published in ভোরের কাগজ on Tuesday, 26 April 2016
রানা প্লাজা বদলে দিয়েছে দেশের পোশাক খাত
কাগজ প্রতিবেদক
ভাই, আমাকে রেখে যাবেন না। আমাকে বাঁচান। আমি বাঁচতে চাই। ৩ বছর আগে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছিলেন ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার শাহিনা খাতুন। উদ্ধারকর্মীদের প্রাণান্ত চেষ্টা, কোটি মানুষের প্রার্থনা- সবকিছু উপেক্ষা করে দেশবাসীকে কাঁদিয়ে না-ফেরার দেশে চলে যান শাহিনা। ৫ দিন ধরে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চলাকালেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান এই পোশাককর্মী।
সে দিনের সেই ভবনধসে শাহিনার মতো ১ হাজার ১৩৬ জন প্রাণ হারান। অঙ্গহানিসহ গুরুতর আহত হন ১ হাজার ৪৩৮ জন। ৩ বছর পার হলেও এখনো সন্ধান মেলেনি প্রায় শতাধিক শ্রমিকের। যাদের সন্ধান পাওয়া গেছে কিংবা আহত হয়ে বেঁচে আছেন, তারাও বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এখনো অনেক শ্রমিক তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। ফিরতে পারছেন না স্বাভাবিক জীবনে। তাদের এই বিসর্জনের প্রেক্ষাপটে ক্রেতারা নড়েচড়ে বসেন। কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশ উন্নয়নসহ জোর দেন নানা সংস্কারের। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে দুই ক্রেতা জোট ও জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনা (এনটিএপি)। ফলে বাংলাদেশ পোশাক খাতের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশের উন্নতিতে গত ৩ বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, ভয়াবহ ধ্বংসের মধ্যেও গড়ে ওঠে নতুন কিছু। অভিশাপ হতে পারে আশীর্বাদ! যেমনটি ঘটেছে স্মরণকালের ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর। রানা প্লাজা ধসের পরে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাকশিল্পে এসেছে বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তন। যেসব পরিবর্তনের সুফল ভোগ করতে পারেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের উত্তরাধিকারীরা। দেশের পোশাক খাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরে পোশাক খাতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশের উন্নতিতে গত ৩ বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ২ ক্রেতা জোট (অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স) এবং জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) আওতায় এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৩২টি কারখানার পরিদর্শন শেষ হয়েছে। অ্যাকর্ডের সদস্য কারখানা ভবনের ১১ শতাংশ কাঠামোগত, ৩৭ শতাংশ বৈদ্যুতিক ও ২৪ শতাংশ অগ্নিনিরাপত্তা-বিষয়ক ত্রুটি সংস্কারকাজ শেষ। অন্যদিকে অ্যালায়েন্সের আওতায় থাকা ৪ দশমিক ১ শতাংশ কারখানার পুরো সংস্কার সম্পন্ন। তবে এনটিএপির অধীন কারখানাগুলোর সংস্কার ধীরগতিতে চলছে। কারখানার নিরাপত্তার কোনো কোনো বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কারখানাগুলো বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশ এগিয়ে আছে। তবে অগ্নি ও কাঠামোগত সংস্কারে পিছিয়ে আছে। এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। একটি কারখানাও সংস্কারের বাইরে রাখা উচিত নয়।
বাংলাদেশে পোশাক খাতে সুশাসনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সন্তোষজনক বলে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, পোশাক খাতে সুশাসনের জন্য গৃহীত ১০২টি উদ্যোগের মধ্যে টিআইবি গত এক বছরে ৬৮টি উদ্যোগের অগ্রগতি পর্যালোচনা গবেষণা করেছে। তিনি জানান, পোশাক খাতে সুশাসনের ক্ষেত্রে ৭৭ শতাংশ উদ্যোগ পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে বা হচ্ছে। তাই বলা যায় এখাতে অগ্রগতি সন্তোষজনক। প্রায় ৯২ শতাংশ কারখানায় ন্যূনতম মজুরি প্রদান করা হয়। অধিকাংশ রপ্তানিমুখী কারখানায় শ্রমিকদের জরুরি নম্বরসহ পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, বিজিএমইএ কর্তৃক শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে এশিয়ান ডেভেলপমেন্টের সিপ প্রজেক্টের আওতায় ৪৩ হাজার ৮০০ জনকে প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ পরবর্তী চাকরির ব্যবস্থা চলমান।
এ ছাড়া রানা প্লাজায় দুর্ঘটনায় হতাহত শ্রমিকদের সহায়তায় সংগৃহীত প্রায় ৩০ মিলিয়ন ইউএস ডলার বিতরণ করা হয়েছে।রানা প্লাজা ধসের পরে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শ্রমিকদের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা দৈনিক দুই ঘণ্টা থেকে ৪ ঘণ্টায় পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০১৩ সালে শ্রম আইন সংশোধনের পর এখন পর্যন্ত ৩৫১টি নতুন ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়েছে। বর্তমানে মোট ইউনিয়নের সংখ্যা ৪৮৩টি।