ড. নুসরাতে আজীজ
Assistant Professor of Economics at Algoma University, Ontario, Canada
Email: nusrate.aziz@algomau.ca
দেশের এমপি, মন্ত্রিপরিষদ, প্রেসিডেন্ট তথা সকল সরকারি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা আসে জনগণের উপার্জনের একটা অংশ থেকে? সরকারি আয়ের মূল উৎস হলো জনগণের দেয়া ‘কর’ (Tax)। সরকার বিভিন্নভাবে নাগরিকদের থেকে কর আদায় করে।
প্রথমত: বছর শেষে জনগণ যে আয়-কর দেয়, সরকারের আয় আসে সেই কর থেকে।
দ্বিতীয়ত: প্রতিদিন দেশের জনগণ যেসব দ্রব্য ক্রয় করে, তার উপর সরকার একটা কর আদায় করে। উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা ওই সব দ্রব্য বিক্রয় করার সময় সরকারের চাপানো কর ক্রেতাদের উপর চাপিয়ে দেয়। দেশের জনগণই হলো এই সব দ্রব্যের ক্রেতা এবং তারাই শেষ পর্যন্ত (ultimately) এই কর পরিশোধ করে।
তৃতীয়ত: বিদেশ থেকে যেসব দ্রব্য আমরা আমদানি করি, তার থেকে সরকার কর (আমদানি শুল্ক) সংগ্রহ করে। যারা বিদেশী দ্রব্য ক্রয় করেন, আল্টিমেটলি তারাই সরকারকে সেই কর দিয়ে থাকেন। এরকম আরো অনেক কর জনগণ সরকারকে দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে সরকারের আয়ের শতকরা প্রায় ৭২-৭৫ ভাগ আসে ‘কর’ (tax) থেকে। তম্মধ্যে প্রায় অর্ধেক আয় (শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ) আসে ব্যক্তিগত আয়কর এবং ভ্যাট (value added tax) থেকে। বাকি অংশ আসে আবগারি শুল্ক (customs duties) এবং অন্যান্য কর থেকে।
সরকার বাজেটের বাকি অর্থ (শতকরা ২৫-২৭ ভাগ) সংগ্রহ করে হয় বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে অথবা দেশের ব্যাঙ্কিং সেক্টর থেকে ঋণ নিয়ে অথবা সরকারি বন্ড ইস্যু করে। বিদেশী ঋণ, ব্যাঙ্ক ঋণ বা বন্ড ইস্যু করা ঋণকে অনুদান (যা কখনো ফেরত দিতে হবে না) ভেবে ভুল করবেন না। সরকারের এই ঋণের টাকা সুদে-আসলে দেশের জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে – আজ বা কাল। এই ঋণের দায় জনগণকেই দিতে হবে। ঋণ কম হলে দায় কম, ঋণ বেশী তো দায় বেশি। এর মানে, সরকার যদি এখন ট্যাক্স কম নিয়ে, অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক ঋণ বেশি নেয়, তবে ভবিষ্যতে জনগণ থেকে বেশি ট্যাক্স নিতে হবে, এই ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করার জন্যে। মোদ্দকথা হলো, জনগণকেই সরকারের রাজস্ব বা উন্নয়ন খাতের সকল খরচ বহন করতে হয়।
বাংলাদেশে ভ্যাটের গড় হার ১৫% এর মতো। ভ্যাট দ্রব্যের প্রতিটি উৎপাদন স্তরে পরিশোধ করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ – একটা শার্ট এর উৎপাদন স্তর হলো ৪ টি। তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে কাপড়, কাপড় থেকে শার্ট, এবং এই শার্ট উৎপাদনকারী থেকে আবার খুচরা বিক্রেতার কাছে যায়, আর ক্রেতা খুচরা বিক্রেতা থেকে শার্টটি ক্রয় করে। ৪ টি উৎপাদন স্তরেই কম বেশি ১৫% ভ্যাট যোগ হয়। বলা যেতে পারে, গড়ে ১০০ টাকার দ্রব্য ক্রেতাকে ১১৫ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। উৎপাদনের ৪ স্তরে জড়িত উৎপাদকগণ পান ১০০ টাকা আর ১৫ টাকা নেন সরকার।
ট্রেডিং ইকোনমিক্সের ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সর্বনিন্ম বেতন ৫,৩০০ টাকা, আর গড় বেতন ১৩,২৫৮ টাকা। যিনি সর্বনিন্ম বেতন পান, তাকে বেশ গরিব শ্রেণীর মানুষ বলা যেতে পারে। তাকেও সরকারকে কমবেশি ৮০০ টাকার মতো ট্যাক্স (ভ্যাট) দিতে হয়। যিনি গড়আয় স্তরে রয়েছেন, তাকে প্রতিমাসে সরকারকে দিতে হয় প্রায় ২০০০ টাকার মতো। যারা মাসে ৩৩,৩৩৩ টাকা আয় করেছেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাকে কমপক্ষে দুই ধরণের কর দিতে হয়েছে। তাদের মাসে কমপক্ষে ৫,২৭৭ টাকা ভ্যাট এবং আয়কর (বছরে ৩,৩৩৩ টাকা) দিতে হয়েছে।
সে যাই হোক, গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী জনগণ ভোট দিয়ে দেশের এমপি নির্বাচন করে। জনগণ এমপি, মন্ত্রী আর প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় পাঠায় যেন তারা জনগণের আয়ের অংশ যা সরকারকে কর হিসেবে দিয়েছে তা সুন্দরমতো দেশের উন্নতিতে কাজে লাগায়। আর আমাদের ক্ষমতায় যাওয়া দলীয় নেতারা ক্ষমতায় গিয়ে সেই ট্যাক্সের অর্থ লুটপাট করে খায়। জনগণের টাকার শতকরা ৮০ ভাগ খেয়ে, যদি ২০ ভাগও কাজে লাগায়, তারা আবার বড় গলায় বলেন, “এই রাস্তা কে দিয়েছে? ওই কাজ কে করেছে? আমরা চাইলে নাও করতে পারতাম, ইত্যাদি, ইত্যাদি…”
জনগণের ঘামঝরা পরিশ্রমের টাকায় যাদের বেতন-ভাতা চলে, তারা জনগণকে ধমক দেন! এ যেন রাজা-প্রজার সম্পর্ক। প্রজাদেরকে রাজার ভাণ্ডারে কর জমা করতে হবে, আর রাজা যখন যা ইচ্ছে হয় তাই খরচ করবেন আর প্রজাদের উপর ছড়ি ঘুরাবেন। আর আমরা বেচারা জনগণ মনেকরি, এই রাস্তা, ওই ফ্লাইওভার, এসবতো আমাদের মন্ত্রী এমপিরাই আমাদেরকে করে দিয়েছেন। আমরা মনেকরি আমাদের ঐসকল এমপি মন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।
ভাবুনতো, আসলে কে কার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত? জনগণের টাকার যারা চলেন, সেসব লোক জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞ হবে, নাকি জনগণ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হবে?