Published in প্রথম আলো on Saturday, 23 April 2016
মধ্যম আয়ের বনাম উন্নয়নশীল দেশ
কী হতে চায় বাংলাদেশ?
জাহাঙ্গীর শাহ
বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে সব পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু সমৃদ্ধি মাপার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সূচকগুলোতে মধ্যম আয়ের দেশ বলতে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি নেই। জাতিসংঘ কিংবা বিশ্বব্যাংক—কারও সূচকেই মধ্যম আয়ের দেশ বলতে কোনো কিছুই নেই।
জাতিসংঘের বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ। পরের ধাপ উন্নয়নশীল দেশ হতে কমপক্ষে আরও নয় বছর লাগবে। ২০২৪ সালের আগে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি লাভের সুযোগ নেই।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। পরের শ্রেণি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে বর্তমান মাথাপিছু আয়কে কমপক্ষে ৪ হাজার ১২৬ ডলার হতে হবে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এখন তা মাত্র ১ হাজার ৮০ ডলার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘২০২১ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিতে চায় সরকার। কোন ধরনের মধ্যম আয়ের দেশ হতে চায়, তা সরকারের পরিষ্কার করে বলা উচিত। কেননা, “মধ্যম আয়ের দেশ” বলতে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে আমরা তো নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছি। মাথাপিছু আয়ের বর্তমান ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা থাকলেও ২০৩০ সালের আগে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে পারব না। তাহলে ২০২১ সালে কোন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মধ্যম আয়ের দেশ হব?’
জাতিসংঘ: বিশ্বব্যাংকের মতো শুধু আয় দিয়ে নয়, উন্নয়নকে টেকসই করতে মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে সূচক তৈরি করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ—তিন শ্রেণিতে ভাগ করে সিডিপি। বাংলাদেশসহ ৪৮টি দেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে। প্রতি তিন বছর পরপর জাতিসংঘের সিডিপি এ তালিকায় থাকা দেশগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে থাকে।
স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা হয়। এগুলো হলো মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি। এসব সূচকে আগের তিন বছরের গড় পয়েন্ট হিসাব করা হয়। উন্নয়নশীল দেশ হতে কমপক্ষে দুটি সূচকে ‘গ্র্যাজুয়েট’ হতে হবে। সিডিপির স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিয়ে ২০১৫ সালের যে পর্যালোচনা, তাতে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে পারেনি। তাই বাংলাদেশকে ২০১৮ সালের পর্যালোচনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ওই বছর যদি বাংলাদেশ বাছাই হয়, তবে ২০২১ সালের পরবর্তী মূল্যায়ন পর্যন্ত সেই অবস্থা ধরে রাখতে হবে। এরপরই কেবল উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাংলাদেশ যোগ্যতা অর্জন করবে। তখনই কেবল উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করবে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসোক)। সেই সুপারিশ জাতিসংঘের সাধারণ সভায় যদি অনুমোদন হয়, তবু উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা কার্যকর হতে আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। সেই হিসাবে, ২০২৪ সালের আগে উন্নয়নশীল দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিশ্বব্যাংক: নিম্ন আয়, নিম্ন মধ্যম, উচ্চ মধ্যম আয় ও উচ্চ আয়ের দেশ—এ চার শ্রেণিতে প্রতিবছর সদস্য দেশগুলোকে মূল্যায়ন করে বিশ্বব্যাংক। গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৪ সালে মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় ১ হাজার ৮০ ডলার।
মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ মার্কিন ডলারের নিচে থাকলে নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংক। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৬ থেকে ৪ হাজার ১২৫ ডলার। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এ আয় ৪ হাজার ১২৬ থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার। এর বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে সেসব দেশকে উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তালিকায় নিম্ন আয়ের ৩১টি, নিম্ন মধ্যম আয়ের ৫১টি, উচ্চ মধ্যম আয়ের ৫৩টি এবং উচ্চ আয়ের ৮০টি দেশ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকও এটলাস পদ্ধতিতে মাথাপিছু জাতীয় আয় নির্ধারণ করে থাকে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ইতিমধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশের শ্রেণিতে পৌঁছে গেছি। নিম্ন কিংবা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ, সেটা বড় কথা নয়। মধ্যম আয়ের চরিত্রে পৌঁছে গেছি, সেটাই বড় কথা। ২০২১ সালে তা আরও সুসংহত হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী ১০-১২ বছরের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে যাব। আবার ২০২১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাব।’