Published in প্রথম আলো on Tuesday, 21 June 2016
পোশাকশিল্প নিয়ে গবেষণা
কারখানা সংস্কারে ৭৪৩২ কোটি টাকা লাগবে
নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের ৩ হাজার ৭৭৮টি তৈরি পোশাক কারখানার বৈদ্যুতিক, অগ্নি ও ভবনের কাঠামোগত ত্রুটি সংস্কারে ৯২ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার বা ৭ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা লাগবে। এর মধ্যে ২৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে।
পোশাক কারখানার বাকি সংস্কার শেষ করতে ৬৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে কয়েকটি বিদেশি দাতা সংস্থার দেওয়া ১৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ঋণ সহায়তা তহবিল আকারে আছে। তবে জটিলতার কারণে সেটি মালিকেরা পাচ্ছেন না। সংস্কারকাজের জন্য বাকি ৪৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার কোথা থেকে আসবে, সেটিরও কোনো হদিস নেই।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সংস্কারকাজের অর্থায়নবিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদনটি গতকাল সোমবার রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। ইমার্জিং মার্কেট কনসালটিংয়ের (ইএমসি) কর্মকর্তা বারনারডো কোনন্ট্রি প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার উইনডি জো ওয়ার্নার, আইএলও বাংলাদেশের ডেপুটি ডিরেক্টর গগন রাজভান্ডারিসহ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
রানা প্লাজা ধসের পর ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স এবং সরকারের জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) আওতায় পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কারখানা পরিদর্শনকাজ চলছে। তিনটি পক্ষ ৩ হাজার ৭৭৮ কারখানা পরিদর্শন করে বৈদ্যুতিক, অগ্নি ও ভবনের কাঠামোগত ত্রুটি চিহ্নিত করেছে। সে অনুযায়ী সংস্কারকাজ করছে কারখানাগুলো।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ হাজার ৭৭৮ কারখানার ৬৭ শতাংশই ছোট। এসব কারখানার প্রতিটিতে কাজ করেন ১ হাজারের কম শ্রমিক। ১ হাজার থেকে ৪ হাজার পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করেন এমন মাঝারি কারখানা ২৯ শতাংশ। ৪ শতাংশ কারখানা বড়, প্রতিটিতে কাজ করেন ৪ হাজারের বেশি শ্রমিক। পরিদর্শন হওয়া কারখানার চিহ্নিত ত্রুটির ৫১ শতাংশই বৈদ্যুতিক, ৩০ শতাংশ অগ্নি ও ১৯ শতাংশ ত্রুটি ভবনের কাঠামোগত। ভবনের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া অন্য ত্রুটি সংশোধনে একেকটি কারখানাকে ২০ হাজার থেকে ৯ লাখ ডলার পর্যন্ত ব্যয় করতে হবে। আর ভবনের কাঠামোগত সংস্কারসহ অন্য সংশোধনকাজে ২৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ ডলার লাগতে পারে।
সংস্কারকাজ বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে কারখানার সম্পর্ক ও চাপ এবং কারখানার আকার, বিশেষ করে শ্রমিকসংখ্যা ও লেনদেনের ওপর নির্ভর করে। বড় কারখানাগুলো দেশের ব্যাংক খাত থেকে তুলনামূলক কম সুদে ঋণ নিতে পারে। ছোট-মাঝারি কারখানার সংস্কারকাজের অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা আছে।
দাতা সংস্থা আইএফসি, জাইকা, এএফডি ও ইউএসএআইডি সংস্কারকাজের জন্য নামমাত্র সুদে ঋণ সহায়তা দিয়েছে। তবে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাত ঘুরে কারখানার মালিকের হাতে সেই ঋণের সুদ গিয়ে ৯-১০ শতাংশে দাঁড়ায়। ঋণের এই উচ্চ সুদের হারের পাশাপাশি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ জামানত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও আর্থিক স্বচ্ছতার অভাবই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘ছোট-মাঝারি কারখানার সংস্বকারের অর্থায়নের জন্য আমরা ১০০টি বৈঠক করেছি। তবে আমরা কিছুই করতে পারিনি। জাইকার ঋণ সহায়তা তিন বছর ধরে আছে। কিন্তু জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি কারখানা ঋণ পেয়েছে। এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত।’ তিনি বলেন, ‘সংস্কারকাজের জন্য কিছু ব্র্যান্ড সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। তবে আমরা জানি না, কত কারখানা সেটি পেয়েছে। ব্র্যান্ড ও কারখানার মালিক কিছুই বলছে না।’
এ বিষয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত জাইকার এক প্রতিনিধি বলেন, কারখানার মালিকেরা আবেদন করলেও ব্যাংক প্রয়োজনীয় কাগজ সরবরাহ করতে না পারায় সংস্কারকাজের জন্য ঋণ পাচ্ছে না।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহম্মদ বলেন, সংস্কারকাজের জন্য ব্যাংকঋণের সুদের হার ৫ শতাংশ হওয়া দরকার। এ ছাড়া ঋণপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াটি অবশ্যই সহজ করতে হবে। এ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সংস্কারকাজের ব্যয় কারখানার জন্য অতিরিক্ত খরচ। ক্রেতারা আগামী কয়েক বছরের ক্রয়াদেশ দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলে মালিকেরা সংস্কারকাজের আগ্রহী হবেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে এইচঅ্যান্ডএম গ্রুপের প্রধান প্রতিনিধি রজার হুবার্ট তাঁর বক্তব্যে বলেন, চীন পোশাকের ব্যবসা ছাড়ছে। আর বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেক। সস্তা শ্রম আছে। ফলে এখানকার সম্ভাবনা অনেক। ব্র্যান্ডরাও বাংলাদেশের সঙ্গে কর্মপরিবেশ উন্নয়নে হাতে হাত রেখে কাজ করছে। তিনি বলেন, সমস্যা নিরসনে সরকার পোশাক কারখানার পক্ষে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার জন্য জিম্মাদার হিসেবে কাজ করতে পারে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, পরিদর্শন হওয়া মোট কারখানার ১৯ শতাংশই মাল্টি ফ্যাক্টরি ভবনে। মাল্টি ফ্যাক্টরি হচ্ছে যে ভবনে পোশাকের পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানও আছে।
আইএলওর গগন রাজভান্ডারি বলেন, অর্থায়ন সক্ষমতা ও ঋণপ্রাপ্তিতে জটিলতার কারণে সংস্কারকাজে কিছু বাধা আসছে। তবে পোশাক ব্যবসাকে দীর্ঘমেয়াদি করতে হলে সংস্কারকাজ শেষ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।