Published in দেশ রুপান্তর on Tuesday 9 April 2019
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সেটা হলো পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার বাড়ছে না, বরং সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার বাড়ছে না, এক জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। পাটের সুতা অর্থাৎ ইয়ার্নের ফেয়ার ২০১০ সালে ছিল ২৭০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে তা হয়েছে ২২৪ ডলার। এই সময়ের মধ্যে তা ২.৯ শতাংশ কমে গেছে। আর হেসিয়ানের বাজার বেড়েছে ০.৬ শতাংশ। সিঙ্গেল ইয়ার্নের বাজার কিছুটা ভালো। সেটা বেড়েছে ৬.৭ শতাংশ। পাটের অন্য পণ্যগুলোর বাজার নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মধ্যে আছে। অর্থাৎ পাটের বাজার তেমন একটা বাড়ছে না। বাড়লেও শ্লথগতিতে বাড়ছে। তাই পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার হয় শ্লথগতিতে বাড়ছে না হলে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে।
সেদিক থেকে বাংলাদেশের বাজারের অবস্থাও আশাব্যঞ্জক নয়। রপ্তানির বাজারে ইয়ার্নের ক্ষেত্রে এবং ফেব্রিকের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়ছে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি তেমন বাড়ছে না বা সীমিত আকারে বাড়ছে। বাংলাদেশ যেহেতু পাটের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ এবং বৈশ্বিক পরিসরে পাটের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে পাটের বাজারে তেমন একটা প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। এসব কারণকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। ১. বহিঃস্থ কারণ ২. অভ্যন্তরীণ কারণ। বহিঃস্থ বা বৈশ্বিক পরিসরে পাটের প্রবৃদ্ধি তেমন একটা বাড়ছে না।
প্রথমত, বিশ্বব্যাপী পাটের চাহিদা তেমন একটা বাড়ছে না। কোনো একটা কারণে পাটপণ্যের চাহিদা বাড়ছে না। তাই পাটের বাজারে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আমাদের ওপর তার একটা চাপ পড়ছে।
দ্বিতীয় কারণ হলো, পণ্য হিসেবে দুর্বল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়া। অর্থাৎ পণ্য হিসেবে পাট তার বিকল্প যেসব পণ্য আছে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। আমরা ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত একটা পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে দেখিয়েছি যে ৭০ শতাশ জায়গায় পলিথিন বা পলি প্রোফাইলিং পণ্য ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি ৩০ শতাংশ জায়গায় পাটপণ্যের ব্যবহার হয়। পলি প্রোফাইলিং বা পলিথিন তৈরি করতে পেট্রোলিয়ামের প্রয়োজন হয়। এখন যেহেতু বৈশ্বিক পরিসরে পেট্রোলিয়ামের দাম কম, তাই পলিথিন সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। এ কারণে সবাই এখন পলিথিনই ব্যবহার করছে। পাটপণ্যের বিকল্প যেসব পণ্য রয়েছে, সেগুলো পাটপণ্য থেকে ভালো করছে। পাটপণ্যের জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
তৃতীয় কারণ হলো, ভারতের বাজার। আমাদের পাটের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। কিন্তু ভারতে আমাদের পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করা হয়েছে। এটি ১৯ ডলার থেকে ৩৫১ ডলার পর্যন্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ পাটের ইয়ার্ন, হেসিয়ান বা পাটের ফেব্রিক করা ব্যাগের ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করা হয়েছে। যখন উৎপাদন মূল্যের চেয়ে অন্য দামে পণ্য রপ্তানি করা হয়, তখন অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি বসে। বাংলাদেশের মিলগুলোতে যে মূল্যে পাটপণ্য উৎপাদন করা হয়, তার চেয়ে অন্য দামে পণ্য রপ্তানি করে। ভারত এই অভিযোগে বাংলাদেশের পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করেছে। বাংলাদেশ এই সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে এই সমস্যার ব্যাপারে যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তাই রাজনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা সফল হয়নি। এই তিনটা কারণই হলো আমাদের পাটপণ্যের রপ্তানির বাজার সংকুচিত হওয়ার বড় বহিঃস্থ কারণ। এই কারণগুলো থেকে সহজেই বেরিয়ে আসা যাবে বা এগুলোর সমাধান সহজেই করা যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। এটা আমাদের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ।
এবার অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করা যায়। প্রথম কারণ হলো, বিজেএমসির দুর্বল কার্যক্রম। একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেভাবে কার্যক্রম করা পরিচালনা করা উচিত বিজেএমসি তা করছে না। একটি ভালো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের লক্ষণ হলো তা কেমন রেট অব প্রফিট কেমন রিটার্ন পাচ্ছে। কিন্তু বিজেএমসির রেট অব প্রফিট বর্তমানে নেতিবাচক। আমরা ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই প্রফিটের হার গবেষণা করে দেখেছি তা সব সময়ই নেতিবাচক। এই নেতিবাচকতার হার কখনো কমলেও তা বেড়েছে অনেকবার। সর্বশেষ তাদের নেগেটিভ প্রফিট হচ্ছে ৪৮৯ কোটি টাকা। এই তথ্যও পূর্ণাঙ্গ কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কেননা বিজেএমসির বিভিন্ন দায় রয়েছে, সরকার অনেক ঋণ পায়, শ্রমিক-কর্মচারীদের গ্র্যাচুইটি রয়েছে, অনেক ধরনের বকেয়া রয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনাদায়ী রয়েছে ৪২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে তাদের অবসরকালীন ভাতা, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি। আবার যারা বিজেএমসির কাঁচা পাট সরবরাহকারী, তাদেরও প্রচুর অনাদায়ী রয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক পর্যায়ে অনাদায়ী রয়েছে। তাই প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্টের প্রকৃত কী অবস্থা, তা নিরপেক্ষ অডিট ছাড়া প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানটির এই দুর্বল কার্যক্রম দিয়ে আসলে পাটশিল্পের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো যাবে না। বৈশ্বিক বাজারের এই অবস্থায় বিজেএমসির মতো দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখা খুবই দুষ্কর। শুধু সরকার ঋণ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তাই এখন প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া মেটানো এবং শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনাদায়ী পরিশোধ করার মতো পদক্ষেপ নিয়ে কীভাবে বিজেএমসিকে সচল করা যায় সেটা সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ হলো, মার্কেট ডিস্টরটিং অ্যাক্টিভিটিস। এটা বলতে বোঝায় যে আপনি যে কোনো দামে বাজারে পণ্য বিক্রি করতে পারেন না। তার একটা নিয়ম আছে। বিজেএমসি যে দামে পণ্য উৎপাদন করছে আর যে দামে পণ্য বিক্রি করছে, তার মধ্যে কিছু সমস্যা রয়েছে। অর্থাৎ এখানে ডাম্পিংয়ের ইঙ্গিত আছে। তাই বিজেএমসি যে মূল্যে উৎপাদন করছে, তার চেয়ে ভিন্ন কোনো দামে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে না। তখন পাটের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য পণ্যগুলো এর চেয়ে কম দামে পাওয়া যাবে। প্লাস্টিক বা সুতোর পণ্য এর চেয়ে অনেক কম দামে পাওয়া যাবে। আবার পাটের যে উৎপাদন ব্যয়, তাতে এই মার্কেট ডিস্টরশন রোধ করা খুবই কঠিন। তৃতীয় সমস্যা হলো চাহিদা। অভ্যন্তরীণ বাজারে যে চাহিদা রয়েছে, তা সরবরাহ করার মতো সক্ষমতা বেসরকারি মিলগুলোর নেই। এখন ডিস্টরশনের অভিযোগে যদি বিজেএমসিকে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে আবার বেসরকারি মিলগুলোর চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা নেই।
উপরোক্ত কারণগুলোর জন্য পাটশিল্প প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। এগুলো থেকে পরিত্রাণের জন্য কিছু সমাধান রয়েছে। প্রথমত, বিজেএমসির যে লুম আছে তা কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির ৫৭ শতাংশ লুম শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য রাখা যেতে পারে। বাকি জায়গায় বেসরকারি জুট মিল বা অন্য ধরনের কারখানা করা যেতে পারে। ছোট ধরনের বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করা যেতে পারে। কিন্তু সেগুলোকে বিজেএমসির আওতায় রাখা যাবে না। প্রকৃত অর্থে বিজেএমসিকে বন্ধ করার সময় এসে গেছে। যখন বিজেএমসি ইস্ট পাকিস্তান জুট মিলস করপোরেশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন তার একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল। কেননা ১৯৬০, ৭০, ৮০-এর দশকে বাংলাদেশে তেমন উদ্যোক্তা শ্রেণি ছিল না। বেসরকারিভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল না। এখন দেশে বেসরকারি খাতে প্রচুর উদ্যোক্তা এসেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। তাই করপোরেশন, বিশেষ করে বিজেএমসির মতো করপোরেশন টিকিয়ে রাখার আর প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করে বেসরকারি শিল্পভিত্তিক পাটকল গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিজেএমসির প্রাইসিং পলিসি ঠিক করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে প্রাইসিংয়ে ডিস্টরশন করছে, তাতে ভারতের মতো বাজার পাটশিল্প হারাবে। আর এই ডিস্টরশন শুধু সরকারি মিলগুলোকে আক্রান্ত করছে না, বেসরকারি মিলগুলোকেও আক্রান্ত করছে। তাই এই প্রাইসিং ডিস্টরশন ঠিক করতে হবে।
তৃতীয়ত, বিজেএমসিতে উচ্চ পদগুলোতে কেউই দীর্ঘমেয়াদে থাকছেন না। আমি একটা হিসাব দিতে পারব যেখানে দেখা যাবে প্রতিষ্ঠানটির উচ্চ পদে কেউই দীর্ঘ মেয়াদে থাকতে পারছেন না। গত ১০ বছরে চেয়ারম্যান, ডিরেক্টর, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, প্রডাকশন ডিরেক্টর, ডিরেক্টর অব রিসার্চ এবং ডিরেক্টর অব ফাইন্যান্স এই ছয়টি পদে কেউই গড়ে সাড়ে সাত মাস থেকে সর্বোচ্চ ১৫ মাস পর্যন্ত স্থায়ী ছিলেন। ফলে তারা কেউই তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারেননি, এই স্বল্প সময়ে দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাননি। কেউই দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা নিতে পারেননি। এটা প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে এক ধরনের বড় প্রতিবন্ধকতা। এর গভর্নেন্স স্ট্রাকচার থেকে সহজে বের হওয়া সম্ভব নয়। কেননা এখানে যারা আসেন, তারাও খুব দীর্ঘমেয়াদে থাকতে চান না। এই দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি হলেও তা খুবই কঠিন।
চতুর্থত, ভারতে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে যে অ্যান্টি ডাম্পিং রয়েছে তা প্রত্যাহার করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া। এ জন্য যে উৎপাদন মূল্যে বিজেএমসি পণ্য তৈরি করছে, তার চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করা। এখন প্রতিষ্ঠানটি যে কাঠামোর মধ্যে আছে, তার মধ্যে একে ঠিক করা খুবই কঠিন। একে প্রতিযোগিতামূলক করা, রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করা এককথায় প্রায় অসম্ভব। তাই এখন বিবেচনা করতে হবে কীভাবে একে কোন কাঠামোয় ঠিক করা যাবে।
পাট ও পাটশিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু অল্প সংখ্যক দেশ এই পাট রপ্তানি করে এবং বাংলাদেশ যেহেতু সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ, তাই এই শিল্পের দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। রপ্তানির বাজার যেহেতু সীমিত, তাই দেশে ক্যাপটিভ মার্কেট তৈরি করতে হবে। এ জন্য সরকারকে পণ্য মোড়ক আইনকে কার্যকর করতে হবে। এখন দেশে যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন হচ্ছে তাতে যদি এই আইন কার্যকর করা যায় তাহলে পাটশিল্পের আশি ভাগ বাজার এখানেই তৈরি করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, জেলা শহরে যেসব সড়ক আছে, তার বিটুমিনের ওপর পাটের তৈরি চট ব্যবহার করা। এই সংক্রান্ত ধারা তৈরি করতে হবে। তৃতীয়ত, পাটপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার তৈরি করতে হবে। নিত্যনতুন পণ্য যাতে এই খাত থেকে তৈরি হয়, সে জন্য গবেষণা প্রয়োজন। চতুর্থত, পাট খাতকে ছোট আকারের শিল্প হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই খাতকে বড় শিল্প হিসেবে বিবেচনা করার অবকাশ নেই। কেননা এই খাত থেকে বড় ধরনের প্রফিট আনা এখন কষ্টকর। তাই করপোরেশনগুলোকে সীমিত করে বেসরকারি খাতের দিকে পাটশিল্পকে নিয়ে যাওয়াই হবে সঠিক উদ্যোগ। এ জন্য করপোরেশনগুলোর জমিগুলোকে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি বা বেপজার সঙ্গে কথা বলে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। মোট কথা, পাটশিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা ও চাহিদা রয়েছে। একে আগামীতে ছোট আকারের বেসরকারি খাতের শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।