Published in আলোকিত বাংলাদেশ on Wednesday, 21 March 2018
সাক্ষাৎকার গ্রহণে এমএ খালেক
আলোকিত বাংলাদেশ: বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি পেল। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই একটি আনন্দ সংবাদ। কিন্তু এই অর্জনের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সুবিধা হারাতে হতে পারে। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?
তৌফিকুল ইসলাম খান: বাংলাদেশ এ মাসেই প্রথমবারের মতো উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্ত পূরণ করেছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকায় এতদিন আমরা আন্তর্জাতিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় কিছু বিশেষ সুবিধা ভোগ করছিলাম। যেমন এই কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো থেকে পণ্য ও সেবা রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সুবিধা সব ধরনের পণ্যের জন্যই প্রযোজ্য। যেমন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশ থেকে আমরা প্রায় সবধরনের পণ্যের জন্যই শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেয়ে থাকি। এটা পাওয়ার কারণ আমরা স্বল্পোন্নত দেশ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশকে জিএসপি কার্যক্রমের আওতায় পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে আসছে। একই ভাবে আমরা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকেও অনুরূপ সুবিধা পেয়ে থাকি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দেয় না ঠিকই; কিন্তু অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশকে এ সুবিধা দিচ্ছে। অন্যদিকে আমরা যদি আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটেও দেখি, তাহলে দেখব, সার্কের ভেতরে আমরা ভারতের যে বাণিজ্য সুবিধা পাই, তা-ও স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবেই পাচ্ছি। এমনকি চীন থেকে আমরা যে বাণিজ্য সুবিধা পাই, তা-ও স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবেই পাচ্ছি। আমরা যখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাব, তখন এসব বাণিজ্যিক সুবিধা থাকবে না। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা মেধাস্বত্ব আইনে কিছু সুবিধা বা ছাড় পেয়ে থাকি। এই সুবিধার সবচেয়ে বড় উপকারভোগী হচ্ছে আমাদের বিকাশমান ওষুধশিল্প। মেধাস্বত্ব আইনে ওষুধশিল্পের লাইসেন্স বাধ্যবাধকতার যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে তা থেকে আমরা অনেকটাই ছাড় পাচ্ছি। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে এক্ষেত্রে আমাদের বেশকিছু সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে বিশেষ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকি। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে এই সুবিধা পাওয়া যাবে না। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। তুলনামূলক কম সুদে আমরা ঋণ পাই। জাতিসংঘের পর্যালোচনা অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উপযোগী বিবেচিত হলে আমরা এসব সুবিধা হারাব। কোনো নতুন বড় ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি না হলে আমরা ২০২৪ সালের মধ্যে চূড়ান্তভাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। তবে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যেসব সুবিধা পাচ্ছিলাম, তা ২০২৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কিন্তু তার পর থেকে আমরা এসব সুবিধা আর পাব না। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যেসব সুবিধা আমরা পাচ্ছিলাম, তা প্রত্যাহৃত হলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাজারে আমাদের প্রায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। এতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাজারে আমাদের পণ্য প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে। তাতে সেখানে পণ্য রপ্তানির ওপর কিছুটা হলেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে যাওয়ার ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্রাস পেতে পারে। এটি আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ওষুধের দাম কম রাখতে পারছি। কারণ বাইরে থেকে আমাদের লাইসেন্স কিনতে হয় না। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে গেলে আমাদের ওষুধের লাইসেন্স বাইরে থেকে কিনতে হবে। ফলে স্থানীয়ভাবে সবধরনের ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাবে। একইভাবে আইটি সেক্টরে আমরা যে ছাড় পাই, তা আর পাব না। বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকার আমরা এখন পাই, তা থাকবে না। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে আমরা কিছু সুবিধাও পাব। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে আমরা যখন বেরিয়ে যাব, তখন আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। আমরা বর্তমানে বিভিন্ন উৎস থেকে তুলনামূলক সহজ শর্তে ঋণ পাচ্ছি, আগামীতে তা না পেলেও অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ পাওয়া যাবে। সেই সুযোগগুলো আমাদের যথার্থ ব্যবহার করতে হবে।
জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করার পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জিএসপি+ নামে একটি নতুন বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করবে। জিএসপি+ সুবিধা প্রাপ্তির জন্য বেশকিছু জটিল শর্ত পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশ কি সেই শর্ত পূরণে সমর্থ হবে?
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তারা জিএসপি+ সুবিধা প্রদান করবেই এমন কোনো কথা নেই। তারা জিএসপি+ সুবিধা দিতে পারে। এই সুবিধা পাওয়ার জন্য আমাদের আবেদন করতে হবে। জিএসপি+ সুবিধা পাওয়ার জন্য বেশকিছু জটিল শর্ত পূরণ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে আমাদের জিএসপি+ সুবিধা পাওয়া সহজ হবে না। জিএসপি সুবিধা পুরোপুরি প্রত্যাহার করার জন্য যে ৯-১০ বছর সময় দেওয়া হবে, তার মধ্যে আমাদের সেসব শর্ত পরিপালনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের দরকার আছে। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ছাড়া আগামীতে বিশ্ববাণিজ্যে টিকে থাকা খুবই কঠিন হবে। কিন্তু রপ্তানি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই গুটিকয়েক পণ্য এবং সামান্য কিছু দেশ বা অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল। যদিও আমরা অনেক দিন ধরেই রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের কথা বলে আসছি; কিন্তু এ ব্যাপারে অগ্রগতি সামান্য। এছাড়াও আমাদের দেশের বিদ্যমান শ্রম আইন আধুনিকায়ন করে আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। শিল্প-কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন করতে হবে। সার্বিকভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের যে অভাব পরিলক্ষিত হয়, তা নিরসন করতে হবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জিএসপি+ সুবিধা পেতে আমাদের কী কী কাজ করতে হবে, তার তালিকা আমাদের জানা আছে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করা খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হয় না। অনেকগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে আমরা স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে আমাদের অগ্রগতি খুব একটা ভালো নয়। আমরা এগুলো বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তি পরিপালনে আমাদের আরও আন্তরিক হতে হবে। আমরা জিএসপি+ সুবিধা পাওয়ার জন্য যখন আবেদন করব, তখন আমাদের নিজেদের মধ্যেও সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এই সক্ষমতা তৈরি করা গেলে আমরা যদি জিএসপি+ সুবিধা না-ও পাই, তাহলেও আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ যদি সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা না পায়, তবে উন্নয়ন অর্থায়ন কি দেশজ সম্পদ দিয়ে সম্পদ সরবরাহ করা যাবে?
এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশে বর্তমানে যে কর-জিডিপি অনুপাত আছে, তা বিশ্বের মধ্যে খুবই কম। এমনকি আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের তুলনায় আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত কম। ফলে আমরা কিন্তু আমাদের দেশের নাগরিকদের যে ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা, সামাজিক সেবা এবং সুরক্ষা যেভাবে দেওয়া উচিত, তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখনও কাক্সিক্ষত মাত্রায় কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারছে না। এসব বিবেচনায় আমাদের কর আহরণের পরিমাণ বাড়ানোটা খুবই জরুরি। করব্যবস্থার আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রস্তাব অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমরা কর কাঠামোর সংস্কারের ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রসর হতে পারিনি। শুধু সংশোধিত ভ্যাট আইন নিয়েই আমরা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখনও নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কাস্টমস আইন এবং প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে আমরা তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারিনি। করব্যবস্থার আইনি সংস্কার খুবই জরুরি। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। কর প্রশাসনের নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যেও দীর্ঘদিন বাধা ছিল। আদালতের রায়ে সেই বাধা দূর হয়েছে। কিন্তু কর আদায় প্রক্রিয়াটা এখনও কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। একে স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। কর প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করা খুবই দরকার। এখনও উপজেলা পর্যায়ে কর প্রশাসনের উপস্থিতি নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য হলেও কর প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। করের সুবিধা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের এখানে কর আদায় ব্যবস্থা আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়বে দুর্নীতি তত হ্রাস পাবে। আরও একটি বিষয়ের প্রতি আমি বিশেষ জোর দেব, তা হলো কর ফাঁকি রোধ করা। আমরা দেখেছি বাণিজ্যের আড়ালে এবং অন্যান্যভাবে কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে এবং এই প্রক্রিয়ায় ফাঁকি দেওয়া করের পরিমাণ অনেক বেশি। কর ফাঁকি রোধ করার জন্য আইনি সংস্কার করতে হবে। একই সঙ্গে কর আদায় ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কর ফাঁকি রোধ করার জন্য আমাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। মুদ্রা পাচার এবং কর ফাঁকির বিষয়টি পরস্পর যুক্ত রয়েছে। অবৈধ অর্থের লেনদেনের একটি বড় অংশ হলো কর ফাঁকি দেওয়া। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কর ফাঁকি রোধে বাংলাদেশের প্রস্তুতি এবং অংশগ্রহণ খুবই কম। শেষে যে কথাটি আমি বলতে চাই, তা হলো, নতুন নতুন করের ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে। দেশের আর্থসামাজিক বৈষম্যের বিষয়টি মাথায় রেখে করের হার বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে এখনও সম্পত্তির ওপর করের হার খুবই কম। দেশে উত্তরাধিকার কর বলে কিছু নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা আছে এবং আর্থসামাজিক বৈষম্য রোধের ক্ষেত্রে এটা খুবই কার্যকর। কৃষির ওপর দীর্ঘদিন ধরে কর আদায় করা হচ্ছে না। কৃষি খাতে কর ধার্য করার বিষয়টি চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। কর প্রদানে সাধারণ মানুষকে যদি উৎসাহিত করতে হয়, তাহলে করের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে করের অর্থ সদ্ব্যবহার করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি সরকারের দক্ষতা এবং সুশাসন না থাকে, তাহলে মানুষ কর প্রদানে আগ্রহী হবে না।
২০১৮ সাল তো জাতীয় নির্বাচনের বছর। এই বছর আমাদের অর্থনীতিতে কী কী নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন?
এক বছর আগের তুলনায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতার পথে দুর্বলতার মুখোমুখি হচ্ছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে লেনদেন আছে, সেক্ষেত্রে আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি চাপ অনুভব করছি। আমাদের আমদানি ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে রপ্তানি আয় বাড়ছে না। অন্যান্য সূত্র থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আগমনও কমে গেছে। রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান এখন খুব একটা ভালো নয়। এই চাপ কিছুটা হলেও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপরও পড়ছে। বাংলাদেশের স্থানীয় মুদ্রা টাকার মূল্যমান কমে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি সরকারি হিসাবে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলেও কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ খুবই কষ্টের মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে বাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গরিব মানুষের জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। ফলে এই সেক্টর সঠিকভাবে কাজ করছে না। কোনো কোনো ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের একধরনের অনাস্থা প্রত্যক্ষ করছি। এটা ব্যাংকের জন্য আমানত সংগ্রহ কঠিন করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ বছর একটি চাপের বছর হবে।
ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি খুবই কম। তারপরও ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এর কারণ কী?
বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি অনেকটাই আমানতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অনেক দিন ধরেই আমানতের সরবরাহ কম ছিল। ব্যাংক তো শুধু বিনিয়োগের জন্য অর্থায়ন করে না, তারা আরও অনেক ধরনের কাজ করে। সেজন্যও ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তির ভোগপ্রবণতা বৃদ্ধির কারণেও ঋণের চাহিদা বেড়ে যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, যারা বৃহৎ ঋণগ্রহীতা তাদের অনেকের মধ্যেই ঋণ ফেরত দেওয়ার প্রবণতা কম। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অনিয়ম হয়েছে। ফলে প্রদত্ত ঋণ নির্ধারিত সময়ে ফেরত আসছে না। প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের মধ্যে এই প্রবণতা আবদ্ধ ছিল। এখন তা ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকেও সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংকের শাখাপর্যায়েও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকের সুশাসন এখন একধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই অবস্থা যদি আমরা শক্তভাবে মোকাবিলা করতে না পারি, তাহলে জনমানুষের মধ্যে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ওপর অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
আইএমএফ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরকালে অন্যান্যের মধ্যে ব্যাংকিং সেক্টরের আইনি সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। এটা কীভাবে দেখছেন?
আইএমএফ প্রতিনিধি দল ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য জোর দিয়েছে। তারা আরও বলেছে, খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং সেক্টরে মালিকানা থেকে শুরু করে পরিচালনা বোর্ড, এমনকি ব্যবস্থাপনা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আইনি সংস্কার খুবই জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই ব্যাংকিং সেক্টরের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। সিপিডি থেকে আমরা কয়েক বছর ধরেই বলে আসছি, ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি দক্ষ এবং কার্যকর কমিশন গঠন করা প্রয়োজনÑ যারা ব্যাংকিং খাতের সমস্যা খুঁজে বের করে তা সমাধানের উপায় বাতলে দেবে। ব্যাংকিং খাতের নিরপেক্ষভাবে সার্বিক নিরীক্ষা দরকার। এটা না করে আমরা যদি শুধু আইনি সংস্কার করি, তাহলে সেটা সাময়িকভাবে কিছুটা স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে না।
ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য একটি কমিশন গঠনের সিপিডির বক্তব্য সম্পর্কে কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যাংকারের সঙ্গে এর আগে আমার আলাপ হলে তারা বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাতের সমস্যা আমাদের সবারই জানা। কাজেই নতুন করে কমিশন গঠনের অর্থ হচ্ছে সময়ক্ষেপণ করা। এখন কমিশন গঠন নয়, প্রয়োজন অ্যাকশন। আপনি কী বলেন?
ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্যাগুলো মোটা দাগে আমরা জানি; কিন্তু সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে আমরা সেভাবে অবহিত নই। কাজেই সমস্যার গভীরতা না জেনে কীভাবে সমাধান করা হবে? আপনি যদি একজন অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা করতে চান, তাহলে প্রথমেই জানতে হবে তার সমস্যা কোন পর্যায়ে আছে বা সমস্যার গভীরতা কতটুকু। তারপরই তো চিকিৎসা করবেন। ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ঠিক একই কথা প্রযোজ্য।
আলোকিত বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ।
তৌফিকুল ইসলাম খান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।