রূপান্তরের জন্য আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি ও নতুন ভাবনা দরকার

Professor Mustafizur Rahman writes on various aspects of the RMG sector, in The Daily Prothom Alo, 15th Anniversary Special Edition on Democracy, published on 6 November 2013.

web_prothom-inside

রূপান্তরের জন্য আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি ও নতুন ভাবনা দরকার

মোস্তাফিজুর রহমান

ED2

মোস্তাফিজুর রহমানরানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে বিরাজমান শ্রমিক-নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ, স্থাপনা সুরক্ষা এবং উৎপাদনব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। নিছক পরিসংখ্যানভিত্তিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এসব আলোচনা এ শিল্পে ‘শ্রমিক অধিকার’, ‘ন্যায্যতা’, ‘বণ্টন’ ও সর্বোপরি ‘মানবিক’ দিকগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে, কর্মসংস্থানে, উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে এ খাতের অনস্বীকার্য অবদানের সুবিদিত বিষয়গুলোর পাশাপাশি এ সাফল্যের মূল শক্তি যে শ্রমজীবী মানুষ, তাঁদের শ্রম-অধিকার আর জীবিকার নিরাপত্তার বিষয়গুলো এখন সামনে চলে এসেছে। তৈরি পোশাক খাতের এ-যাবৎকালীন অর্জনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনেই শ্রমিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো তাই আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে, তাগিদ দিচ্ছে এ নতুন ভাবনা যেন আমরা করি আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত ছয় মাসে বিভিন্ন পর্যায়ে নানামুখী উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে—সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে; মালিকপক্ষ, ক্রেতা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে; একক এবং যৌথ ভিত্তিতে। গ্রহণ করা হচ্ছে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা; সেগুলোর বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব পরিকল্পনা যাতে সময়মতো ও মানসম্পন্নভাবে বাস্তবায়িত হয়, তার গুরুত্ব সমধিক। ইতিবাচক দিকটি হলো এখন পর্যন্ত মূল আন্তর্জাতিক ক্রেতাগোষ্ঠী বাংলাদেশকে বর্জন করে নয়, বরং বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন সংস্থা ও মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ, বেসরকারি সংস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করে ও কমপ্লায়েন্স পরিস্থিতির মানোন্নয়নে সহায়তা প্রদান করার মাধ্যমেই বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁদের ব্যবসা অব্যাহত রাখতে আগ্রহী। মনে রাখতে হবে, শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উৎপাদননিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের শৈথিল্য এবং গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেকোনো দুর্বলতা ভবিষ্যতে এ অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অনেকে এ প্রসঙ্গে বলে থাকেন, ক্রেতাদের অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ নেই, সুতরাং তাঁরা আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। এটি মনে হয় একটি ভ্রান্ত ধারণা।

স্মর্তব্য, গত অর্থবছরে ২১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বিশ্বে দ্বিতীয়, আর বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ চীনের এ খাত থেকে আয় ছিল ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাজার বিশ্লেষণ থেকে অনুমিত হয়, এর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হওয়া সম্ভব। চলমান অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তৈরি পোশাক খাতের আয় গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ছিল ২৪ শতাংশ বেশি। রানা প্লাজায় ধস-পরবর্তী রপ্তানি অর্ডার যদিও রপ্তানি আয়ে মূলত অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্বে দেখা যাবে, এখন পর্যন্ত অর্ডারের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাতে প্রতীয়মান হয়, রপ্তানির বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। তবে আগেই যেটা বলা হয়েছে, ক্রেতাদের কৌশল পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিফলিত হয় না বরং মধ্য মেয়াদে, দু-তিন বছরের মধ্যে তার ফলাফল দৃশ্যমান হতে শুরু করে—স্থানান্তরের জন্য সম্ভাব্য নতুন সোর্স দেশের উৎপাদকদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির জন্য সময় দিতে হয়। সে ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে তাই আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। ‘একর্ড’সহ সব পরিকল্পিত অ্যাকশন প্ল্যানের মানসম্মত বাস্তবায়নের তাগিদটা তাই এখানেই এবং প্রয়োজনটা এখনই। এখানে স্মর্তব্য, রানা প্লাজায় ধস-পরবর্তী কার্যক্রম বাস্তবায়ন ধারাবাহিকভাবে পরিবীক্ষণের জন্য সিপিডি বেশ কিছু সংগঠনের সমন্বয়ে একটি পার্টনারশিপ গড়ে তুলেছে। ত্রিপক্ষীয় (সরকার, ক্রেতাসংগঠন, আইএলও) উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগ অ্যাকশন প্ল্যানের যথাযথ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

পোশাক শিল্প শ্রমিকদের জন্য চাই উপযুক্ত মজুরি। ছবি: হাসান রাজাবর্তমানে তৈরি পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য মজুরি বোর্ড যে কাজ করছে, তাকে রানা প্লাজার ঘটনা-পরবর্তী বাস্তবায়িত উদ্যোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা উচিত হবে না। তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার বিষয়টি শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান ও জীবিকার উন্নয়নের প্রশ্নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার ও বাঁচার মতো মজুরি পাওয়ার অধিকার, তাঁদের কর্মপরিবেশ ও জীবনের নিরাপত্তা পরিবেশের উন্নয়নের থেকে পৃথক কোনো বিষয় নয়। মনে রাখতে হবে, শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার শুধু শ্রমিকদের দাবি উত্থাপনের হাতিয়ার হিসেবে নয়, উৎপাদনপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদনবান্ধব পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম একটি শক্তি হিসেবেও বিবেচনার দাবি রাখে। তৈরি পোশাক খাতের সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় দেখা গেছে, যেসব কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন ছিল, শ্রমিক নেতারা সেসব কারখানায় শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন; অন্য কারখানায় তাঁরা তা করতে সক্ষম হননি। কারণ, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা অন্য কারখানার নেতাদের ওইসব কারখানার শ্রমিকেরা কখনো দেখেনওনি, ফলে তাঁদের মানতেও চাননি। মালিকপক্ষ যদি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রদানের ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিঘাতের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করেন, তাহলে তাঁরা বুঝতে পারবেন যে মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদে এতে তাঁরা লাভবানই হবেন। দেশে দেশে শিল্পায়নের ইতিহাস ও শিল্প খাতের উন্নয়ন-অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। বাংলাদেশের জিএসপি-সুবিধার প্রেক্ষাপটেও এর গুরুত্ব সমধিক, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সে সুবিধা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেই হোক অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়নে সে সুবিধা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রেই হোক (ইইউর জিএসপি স্কিম ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নবায়িত হওয়ার কথা)। আইএলও কনভেনশনসহ যেসব কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, সে পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে জবাবদিহির চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়বে, আর সেদিক থেকেও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। আমাদের নতুন শ্রম আইনেও এ অধিকার সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

বর্তমানে নিম্নতম মজুরির যে আলোচনা চলছে, তা এ সামগ্রিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা ঠিক হবে না। মালিকপক্ষকে এ বিষয়টিকে দেখতে হবে ‘আলোকিত স্বার্থপরতার’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। দুঃখজনক হলো, তাঁরা প্রাথমিক যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেখানে মূল্যস্ফীতির হিসাব সঠিকভাবে করা হয়নি। ২০১০ থেকে ২০১৩ সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের নিরিখে সে প্রস্তাব প্রণীত হয়নি। ইতিমধ্যে শ্রমিকেরা তাঁদের একটি হিসাব দিয়েছেন; বিল্স-এর পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে; ‘লিভিং ওয়েজ’-এর ভিত্তিতে দুই পর্যায়ে বাস্তবায়নের সুপারিশসহ সিপিডিও একটি পরামর্শ রেখেছে। আমরা আশা করব, আলোচনার মাধ্যমে মালিক ও শ্রমিকপক্ষ একটি সমঝোতায় আসতে পারবে এবং মজুরি বোর্ড তার ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব রাখতে সক্ষম হবে। তবে এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে।

এটা জানা কথা, ২০০৬ সালে যখন দীর্ঘ ১২ বছর পর তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়, তখন মজুরির পরিমাণ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও তখনকার বাস্তবতার নিরিখে সঠিকভাবে করা হয়নি। বিশ্বব্যাংকেরই একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এ সময়ে বাংলাদেশের প্রকৃত জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০ শতাংশের বেশি, যেখানে ন্যূনতম মজুরির মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ৪ শতাংশ। বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৬০টিরও বেশি দেশে বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের নীতি প্রচলিত আছে। বলা বাহুল্য, সে নির্ধারণে পদ্ধতিগত ভিন্নতা আছে। শুধু গড় মূল্যস্ফীতি নয়, জাতীয় আয়ের গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ন্যূনতম মজুরির ধারাবাহিক সমন্বয় সাধন সারা বিশ্বে একটি সাধারণভাবে প্রচলিত ও স্বীকৃত পদ্ধতি। ২০১০ সালে যখন ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারিত হয় ও সপ্তম গ্রেডের জন্য তা ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়, তখন প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে ও প্রকৃত জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির সাপেক্ষে শ্রমিকেরা পূর্ববর্তী ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পেরেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মালিকপক্ষের সম্মতিক্রমে এটা সম্ভব হয়েছিল। তার পরও বলতে হয়, ২০১০ সালে খানাজরিপ-ভিত্তিক দারিদ্র্যসীমা আয় ছিল ঢাকা শহরের জন্য মাসে দুই হাজার ৩০ টাকা। পরিবারে আরেকজন প্রাপ্তবয়স্ক নির্ভরশীল আছেন, সেটা বিবেচনায় নিলে দুজনের জন্য দারিদ্র্যসীমা আয় তখন ছিল মাসে চার হাজার ৬০ টাকা, যেখানে সপ্তম গ্রেডের নিম্নতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল তিন হাজার টাকা। দারিদ্র্যসীমার সে হিসাবকে বিবেচনায় নিয়ে এবং ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ হয়েছে হিসাব করলে দুজনের পরিবারের জন্য এ অঙ্ক দাঁড়াবে মাসে পাঁচ হাজার ২৮০ টাকার কাছাকাছি। বিশ্ব ভেল্যু চেইনে নিয়োজিত একজন শিল্পশ্রমিককে দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় জীবনধারণ করতে হবে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। আর মজুরির সঙ্গে ওভারটাইম যোগ করে হিসাব করাটাও পদ্ধতিগতভাবে সঠিক নয়।

পোশাক শিল্প শ্রমিকদের জন্য চাই উপযুক্ত মজুরি। ছবি: হাসান রাজা
পোশাক শিল্প শ্রমিকদের জন্য চাই উপযুক্ত মজুরি। ছবি: হাসান রাজা

নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একই সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে, অন্য যেসব গ্রেডের জন্য নিম্নতম মজুরি নির্ধারিত হবে, সেটা যাতে এমনভাবে হয়, যাতে করে শ্রমিকের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির সপক্ষে মজুরি-কাঠামোতে যথেষ্ট মাত্রায় প্রণোদনা থাকে। বিষয়টির প্রতি আগের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের সময় প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এটির দরকার আছে উদ্যোক্তাদের কথা বিবেচনায় রেখেও, যাতে তাঁরা উৎপাদনশীলতাকে উৎসাহিত করতে পারেন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সুফল পেতে পারেন। মজুরি আরও কম রেখেই হয়তো সম্প্রসারিত বাজার আমরা দখলে নিতে পারি, কিন্তু সেটা কি আমরা চাই? নিশ্চয়ই নয়। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে শ্রমিককে একটি গ্রহণযোগ্য মজুরি দিয়েও কীভাবে আমরা আমাদের এ গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রসার ও প্রবৃদ্ধি ভবিষ্যতে অব্যাহত রাখতে পারি। উৎপাদনশীলতা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করার সক্ষমতা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, আর তার জন্য প্রয়োজন প্রণোদনা-কাঠামোর প্রয়োজনীয় বিন্যাস ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রদান।

ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। অনেক দেশে সরকার শ্রমিকদের জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে, যা শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখে, আর মালিকের ব্যয়েরও সাশ্রয় করে। যেমন চীন ও ভিয়েতনামে শ্রমিকের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা বহুলভাবে প্রচলিত একটি সুবিধা; কোনো কোনো দেশে সরকার শ্রমিকদের জন্য সুলভে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে থাকে; অনেক দেশে প্রচলিত আছে বিনা খরচে সরকারি চিকিৎসার সুবিধা, পেনশনের সুবিধা। সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা উদ্যোক্তাদের ব্যয় সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা তাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করতে সক্ষম হন। অবকাঠামো-সুবিধা, স্পেশাল ইকনোমিক জোনের সুবিধা মালিকদের উৎপাদন-ব্যয় হ্রাসে সাহায্য করে। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে এসব বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়া হয়।

অন্য যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো ক্রেতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ক্রেতারা যদিও ‘এথিকাল বায়িং’-এর কথা বলে থাকেন, তাঁরা ‘এথিকাল সোর্সিং’ অনেক সময়েই করেন না, বরং রপ্তানিকারকদের ওপর মূল্যহ্রাসের জন্য সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করে থাকেন। সে মূল্যে সরবরাহ করতে গিয়ে অনেক সময় উদ্যোক্তা বাধ্য হন এমন সব কারখানায় সাব-কন্ট্রাক্ট করতে, যেখানে মজুরি, কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি অত্যন্ত নিম্নমানের। ‘এথিকাল বায়িং’ ও ‘এথিকাল সোর্সিং’-এর দ্বিমুখী নীতি থেকে ক্রেতারা যাতে বের হয়ে আসেন, সে জন্য তাঁদের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে এবং তাঁদের এ ক্ষেত্রে জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এ-যাবৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্প কয়েকটিসহ মূলত ইউরোপীয় যে ৯০টি কোম্পানি এ সংক্রান্ত ‘একর্ড’ স্বাক্ষর করেছে এবং উত্তর আমেরিকার যেসব কোম্পানি ভিন্ন উদ্যোগে বিভিন্ন অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করছে এবং ত্রিপক্ষীয় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেসব উদ্যোগের আওতায় এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। রপ্তানিকারকেরা যাতে ভালো মজুরি দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন, তৈরি পোশাকের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা হবে একটি বিবেচ্য বিষয়। তৈরি পোশাকের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে বর্তমানে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে—ফেয়ার প্রাইসের কথা বলা হয়েছে, ফ্লোর প্রাইসের কথা বলা হচ্ছে, ফ্লোর মজুরির কথা বলা হচ্ছে। এ কথা সুবিদিত যে, আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের ‘বায়ার-ড্রিভেন’ মডেলে আমাদের মতো দেশের উদ্যোক্তাদের জন্য উৎপাদনমূল্য এমন পদ্ধতিতে নির্ধারিত হয়, যেখানে ক্রেতাদের ক্ষমতা অনেকটাই নিরঙ্কুশ। বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা যায়, খুচরা বিক্রয়মূল্যের প্রায় ৬৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ ক্রেতা ও বায়িং হাউসের কর্তৃত্বের মধ্যে থাকে। সরবরাহকারীদের আন্তদেশীয় প্রতিযোগিতা ও নির্দিষ্ট সরবরাহকারী দেশের আন্ত-উৎপাদক প্রতিযোগিতার কারণে ও ক্রেতা-আধিপত্যের ফলে তৈরি পোশাকের মূল্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করা অনেকটাই সহজ। বর্তমানে যে উদ্যোগগুলো গৃহীত হচ্ছে, তার আওতায় এসব বিষয় উত্থাপন করা উচিত। কমপ্লায়েন্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের অংশীদারি ও দায়ভার গ্রহণের প্রশ্নটিও বিদেশি ক্রেতাদের সামনে নিয়ে আসা উচিত। শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সহায়তা প্রদানের বিষয়গুলো এককালীন কোনো ব্যাপার নয়, বরং অব্যাহত ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ হিসেবে দেখতে হবে।

মধ্য মেয়াদে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের কাঠামোগত একটি বড় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে হয়। শ্রমিকদের ভালো মজুরি দিতে হলে ভেল্যু চেইনে অগ্রসংযোগ স্থাপন, বেসিক আইটেম থেকে উন্নতমানের তৈরি পোশাক উৎপাদনে উত্তরণ, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, মাল্টিটাস্কিংয়ের প্রচলন, সাব-কন্ট্রাক্টিংয়ের বর্তমানে প্রচলিত মডেলের বিকল্প অনুসন্ধানসহ এ খাতকে ভবিষ্যতে বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। এসব সম্ভাব্য পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে প্রয়োজন হবে যথাযথ নীতি প্রণয়ন, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ সমন্বিত উদ্যোগের। আর সে লক্ষ্যে যথাযথ প্রস্তুতি এবং পদক্ষেপ গ্রহণ এবং মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল প্রণয়নের সময় এখনই।