Published in আমাদের সময় on Sunday, 17 July 2016
বৈদেশিক বিনিয়োগে শুভঙ্করের ফাঁকি
হারুন-অর-রশিদ
আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা এবং অনুকূল পরিবেশের অভাব বাংলাদেশে বিনিয়োগের অন্যতম বাধা বলে মনে করছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু গত বছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ ২২৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলার সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে বলে প্রকাশ করেছে বিনিয়োগ বোর্ড। কিন্তু এর মধ্যে বিদেশ থেকে এসেছে মাত্র ৬৯ কোটি ৬৬ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৩১ শতাংশ। বাকি ৬৯ শতাংশের বেশি প্রকল্প সম্প্রসারণের জন্য আগের মুনাফা এবং বাংলাদেশে কার্যরত অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই অর্থকেও এফডিআই হিসেবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। বাস্তবে এগুলো বিদেশ থেকে আসেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে আয়ের অর্থ এবং অন্য কোম্পানির ঋণকে এফডিআই হিসেবে দেখানো সঠিক হচ্ছে না। এ কারণে এফডিআইয়ের সঠিক চিত্র প্রতিফলিত হয় না।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্পর্কিত জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনাইটেড নেশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আঙ্কটাড) বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে-২০১৫ দেখা যায়, গত ২০১৫ সালে সর্বমোট ২২৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলার নিট এফডিআই এসেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলধন হিসেবে নতুন বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৬৯ কোটি ৬৬ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের মাত্র ৩১ দশমিক ১৬ শতাংশ। অবশিষ্ট বিনিয়োগের মধ্যে কোম্পানি আয় থেকে পুনর্বিনিয়োগ ১১৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার এবং আন্তঃকোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। নিট বিনিয়োগের স্থানীয় কোম্পানি নিজস্ব আয় ও অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ থেকেই হয়েছে ৬৯ শতাংশের বেশি।
গত ২০১৪ সালে সর্বমোট এফডিআই এসেছে ১৫৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে নতুন বিনিয়োগ মাত্র ২৮ কোটি ডলার; যা মোট বিনিয়োগের মাত্র ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে পুনর্বিনিয়োগ ছিল ৯৯ কোটি ডলার এবং আন্তঃকোম্পানির ঋণ থেকে বিনিয়োগ ছিল ২৮ কোটি ডলার; যা মোট বিনিয়োগের ৮২ শতাংশ।
এ ছাড়া গত ২০১৩ সালের সর্বমোট ১৬০ কোটি ডলারের মধ্যে বিদেশ থেকে আসা নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫৪ কোটি ডলার। এই অর্থ মোট বিনিয়োগের ৩৩ শতাংশ। এ ছাড়া পুনর্বিনিয়োগ ছিল ৭৯ কোটি ও আন্তঃকোম্পানি ঋণ থেকে বিনিয়োগ ছিল ৩৬ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এখনো পুরোপুরি আস্থা ফিরে আসেনি। ফলে দেশি ও বিদেশি কোনো বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না। নতুন করে জঙ্গি হামলাও এফডিআইয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
গত মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-বাংলাদেশ বাণিজ্য বিষয়ে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সংলাপে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগে উৎসাহিতকরণ ও নিয়ন্ত্রণের যে আইন রয়েছে, তা বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিনিয়োগের মুনাফার অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যাওয়া ও পুনর্বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকে জটিল প্রক্রিয়া ৫০ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগকে কঠিন সমস্যার মধ্যে ফেলে। এ ছাড়া করপোরেট কর হারও অন্যতম বাধা। এসব কারণে বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বাংলাদেশে এফডিআইয়ের অবস্থা খুব সামান্য। জিডিপির এক শতাংশেরও কম। বর্তমানে যে বিনিয়োগ আসছে তার বেশিরভাগই বিদেশি কোম্পানির আয় থেকে পুনর্বিনিয়োগ।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত বছরে এফডিআই বেড়েছে। কিন্তু আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। ভিয়েতনামে এফডিআই ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার। আমাদের দেশে যে হচ্ছে তার বেশিরভাগ আগের মুনাফা থেকে পুনর্বিনিয়োগ। নতুন আগমন অর্থাৎ ইক্যুয়িটি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এজন্য অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান, ব্যবসার পরিবেশ ও পদ্ধতি সহজ করতে হবে। মুনাফা থেকে পুনর্বিনিয়োগ বেশি হলেও মোট মুনাফার তুলনায় সেটি কম। মুনাফা থেকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি অঙ্ক বিনিয়োগকারীরা নিয়ে যাচ্ছেন। এই বিনিয়োগ যাতে বাড়ানো যায় সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুনর্বিনিয়োগ ও আন্তঃকোম্পানির ঋণকে এফডিআই হিসেবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এটি তথ্য-উপাত্তকে বড় করছে ঠিক কিন্তু অর্থনীতিতে তা প্রভাব ফেলছে না। এফডিআই প্রবাহের ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো রয়েছে তা বিদেশিরা বারবার বলে আসছেন। সেগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, এফডিআই প্রবাহ বেড়েছে। মূল বিনিয়োগ থেকে অর্জিত মুনাফার কিছু অংশ বিনিয়োগকারীরা নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন, কিছু অংশ এদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে। তারা চাইলে সব অর্থই নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু একটি অংশ আমাদের দেশে বিনিয়োগ করছেন। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে সহায়তা করছে।