Published in Alokito Bangladesh on Sunday, 11 May 2014.
২০১৪-১৫ আসছে বাজেট : ভাবনা যাদের
বাস্তবসম্মত বাজেটের জন্য চাই গতিশীল অর্থনীতি : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
বাজেট তো বড় হতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়তে হবে, বাড়তে হবে আয়ও; সেহেতু বাজেট বড় হওয়াটা বড় বিষয় নয়, বরং বাজেটের অন্তর্নিহিত যে যৌক্তিকতা এবং সেটার তথ্যগত ভিত্তি, সেগুলো ঠিক হওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো দেশে এখনও ১৬ থেকে ১৭ শতাংশের মতো মোট রাষ্ট্রীয় দেশজ ব্যয় আছে; সেটা ২০ শতাংশের উপরে ওঠাটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশের যে বিনিয়োগের দাবি, সেটার জন্য এটি খুবই প্রয়োজনীয়। আর সরকার ব্যয় করলে কিছু না কিছু তো উন্নয়ন হবেই। এতে হয়তো দক্ষতার অভাব থাকতে পারে, কিন্তু উন্নয়ন হয়। তা না হলে প্রবৃদ্ধি আসছে কোথা থেকে?
প্রথম কথা হলো, বাজেট বাস্তবসম্মত হতে হবে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বিনিয়োগ, বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পতন ঘটেছে। এখনও আমরা এর কোনো উন্নতি লক্ষ করছি না। সে কারণে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং সরকারের যে বিনিয়োগ, সেটার দক্ষতা বৃদ্ধিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটা হলো, সরকারের বাজেটের যে আর্থিক কাঠামো, সেটার সংহতি, তার যৌক্তিকতা, তার বাস্তব ভিত্তি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর পুরো জিনিসটাই অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত হবে সরকারের সম্পদের লভ্যতার ওপর ভিত্তি করে; বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সে কী পাচ্ছে এবং বৈদেশিক উৎস থেকে যেটা পাবে সেটার যে প্রাক্কলন করা হয়, সেটা কতখানি বস্তুনিষ্ঠ করে থাকে- সেসবের ওপর। সে হিসেবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আর্থিক কাঠামোর সংহতি এবং সম্পদের লভ্যতা নিশ্চিত করা মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াবে বাজেটের জন্য।
বাজেট অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। রাজনীতিতে তো অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা থাকবেই। রাজনৈতিক দর্শন ছাড়া তো আর বাজেট তৈরি হয় না। যেহেতু সরকার রাজনৈতিক, তাই সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, তা বাজেটের ভেতর তো থাকতেই হবে। তাই বাজেটের ভেতর সবসময় রাজনীতি থাকে।
বাজেটের একটা বড় বিষয় হলো নির্বাচনের পরে অর্থনীতির যে গতিশীলতা আমরা আশা করেছিলাম, তা গত তিন মাসে আসেনি। সুতরাং আগামী তিন মাসে কী গতিশীলতা আসে, তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেটকে কতটুকু শক্তিশালীভাবে সরকার সামনে আনতে পারবে। গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস বিভিন্ন রাজনৈতিক ডামাডোল, ধ্বংসাত্মক কাণ্ড ইত্যাদি গেছে। গত তিন মাসে আপাত শান্তি বিরাজ করলেও আমরা দেখেছি, ঋণপ্রবাহ বাড়েনি, রেমিট্যান্স কমে গেছে, বার্ষিক উন্নয় বাস্তবায়নের হারও খুব বেশি ত্বরান্বিত হয়নি। আমদানি বৃদ্ধি পেলেও কিছু পুঁজি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি; তাই আগামী বাজেটের অনেকখানি নির্ভর করবে আগামী তিন মাস কেমন করে অর্থনীতির ভেতরে এগোবে। এ তিন মাসে যদি এক ধরনের মোমেন্টাম বা তরল সৃষ্টি হয়, তাহলে এটা বাজেটের জন্য উপকারী হবে। দ্বিতীয় যে সমস্যা বাজেটের তা হলো, বাজেটের বাইরে যেটা রয়েছে অর্থাৎ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আয়তন নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি করা দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানে এক হাজারের উপরে প্রকল্প রয়েছে, যেখানে নামেমাত্র বরাদ্দ দেয়া হয় বিভিন্ন সময়। যেগুলো শেষ হওয়ার কথা রয়েছে, এমনকি শেষ করার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে, সেখানেও পর্যাপ্ত অর্থ দেয় হয় না। তার পরিবর্তে অননুমোদিত বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প, বিশেষ করে যৌক্তিকতাবিহীন রাজনৈতিক বিবেচনার প্রকল্প বিভিন্নভাবে ঢুকছে। বাজেট আয়তনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দক্ষতা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব সেভাবে আসছে না। তাই এবারের বাজেটে একটা বড় দায়িত্ব ছিল প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা। চিহ্নিত অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোকে অত্যন্ত সততার সঙ্গে কার্যকর করা। মাঝে মাঝে শেষ করার জন্য অগ্রাধিকার চিহ্নিত হয়, কিন্তু তারপর অর্থ এবং প্রশাসনিক সমর্থন দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন ঠিকমতো করা হয় না। তাই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির দিক থেকে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সম্পদের লভ্যতার ক্ষেত্রে যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো কয়েক বছর ধরে যেভাবে কর আদায় বাড়ছিল, কর আদায়ের সে গতি কিছু দিন হলো শ্লথ হয়ে গেছে। সে গতি আবার আগামী বছর সরকার ফিরিয়ে আনতে পারবে কিনা, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহার আমাদের অর্থনীতিতে কমে গেছে অনেক। সুবিধাজনক শর্তে বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার করতে না পারলে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন চাহিদা, তা মেটানো কষ্টকর হয়ে পড়বে। কারণ শুধু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উন্নয়ন চাহিদা মেটানো খুবই কষ্টকর হবে আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য। আর যদি শুধু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এ চাহিদা মেটাতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে টান পড়বে। পদ্মা সেতু অবশ্যই আমরা নিজের টাকায় করতে পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নিজের টাকায় করলে অন্য কোনো না কোনো জায়গায় টান পড়বে। যদি নতুন কোনো অর্থের উৎস অভ্যন্তরীণভাবে বা বৈদেশিকভাবে সেটার সঙ্গে যুক্ত না করতে পারি, তাহলে সমস্যা প্রকট হবে। রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে বড় ধরনের যে দুশ্চিন্তার কারণ, সেটা হলো বিগত সময়কালে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অনেক ঋণ নিয়েছে। এ ঋণ পরিশোধজনিত ব্যয় এখন প্রায় ২০ শতাংশের কাছাকাছি পেঁৗছেছে। এত বড় অংশ যদি রাজস্ব ব্যয়ের ঋণ পরিশোধ করতে চলে যায়, তাহলে অন্যান্য উন্নয়ন সমর্থক কাজের জন্য টাকা পাওয়া সরকারের জন্য কষ্টকর হবে। বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হলো, এখন অনেক বৈদেশিক সাহায্য পাইপলাইনে রয়েছে। সেগুলোকে প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে কী কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা এক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হবে। শেষ যেটা হলো, এ সবকিছু করার জন্য সরকারের দরকার ছিল উন্নয়ন প্রশাসনের কিছু মৌলিক সংস্কার। সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট যে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, সেটা পাস হলো না, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কার্যকর করতে পারল না এখন পর্যন্ত, স্থানীয় সরকারের কাছে বিকেন্দ্রায়ন হলো না এখন পর্যন্ত। ভেতরের অভ্যন্তরীণ যে সমন্বয় আর্থিক খাতকে কেন্দ্র করে, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে এ মুহূর্তে যে বিপর্যয় হয়েছে, সেটার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না করে শুধু অর্থ বরাদ্দ দিয়ে এর কার্যকর ব্যবহার বা দক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে না।
অনুলিখন : সজীব হোমরায়