Published in Shokaler Khobor on Tuesday, 22 April 2014.
রানা প্লাজা-পরবর্তী উদ্যোগে সমন্বয়হীনতা রয়েছে
মোস্তাফিজুর রহমান
রানা প্লাজার মতো এত ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা বিশ্বের আর কোথাও ঘটেনি। গত বছরের ২৪ এপ্রিল এই দুর্ঘটনার পর সারাবিশ্বে যেমন আলোড়ন তুলেছিল, ঠিক তেমনি দুর্ঘটনার এক বছর পূর্তিতে আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার রানা প্লাজা দুর্ঘটনার এক বছর পূর্তি হচ্ছে। কিন্তু এই এক বছরে ক্ষতিগ্রস্তরা কতটা ক্ষতিপূরণ পেল, আর শিল্পমালিকরাই-বা কতটা সচেতন হলো তার হিসাব-নিকাশের সময় এসেছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ও এর পরবর্তী এক বছর সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান সকালের খবরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাত্কারে বলেছেন, রানা প্লাজা-পরবর্তী ঘটনায় যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনা নিয়ে তিনি আরও অনেক কথা বলেছেন।
প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সকালের খবর-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসএম আলমগীর
সকালের খবর : রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর এক বছর হতে যাচ্ছে। এই এক বছরে হতাহত শ্রমিকদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা কি যথেষ্ট বলে আপনি মনে করেন?
মোস্তাফিজুর রহমান : রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি একদিক থেকে খুবই প্রয়োজনীয়, আবার অন্য দিক থেকে খুব জটিলও। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরকে চিহ্নিত করা এবং ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যেও নানা ধরনের ক্যাটাগরি রয়েছে। কেউ মারা গেছেন, কেউ পঙ্গু হয়ে গেছেন, পঙ্গু হয়ে সুস্থও হয়েছেন কিন্তু কাজ নেই। সুতরাং বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রশ্ন আসছে। সেদিক থেকে দেখলে শুরুতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী একটি ফান্ড করেছিলেন, বায়াররাও একটা উদ্যোগের কথা বলেছেন এবং কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু কিছু দিয়েছেনও। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকেই অনেকভাবে সহায়তা করেছেন। আমার মনে হয়, এখানে একটা সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল। হাইকোর্ট যে রুল দিয়েছিলেন তার ভিত্তিতে একটি অ্যামাউন্ট ঠিক করা হয়েছে। বিজিএমইএও প্রথম দিকে একটা সংখ্যার কথা বলেছিল। এসব দিক বিবেচনা করে বললে বলতে হয়, সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে একটা ক্যাটাগরি ঠিক করে দ্রুত এটা নিষ্পত্তি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেই জায়গায় এক বছর হয়ে গেছে কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে তা খুবই স্লথ। এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার-যারা নিঃস্ব হয়ে গেছেন, অনেক ছেলেমেয়ে পিতৃ-মাত্রীহীন হয়ে গেছেন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে তারা হারিয়েছেন। অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। এসব পরিবার গত এক বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিভিন্ন সময় তাদের যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় এবং তাদের আশু ও দীর্ঘকালীন চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আমার মনে হয়, ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য যত সোর্স রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি সুনির্দিষ্ট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রয়োজন। যেহেতু এক বছর পূর্ণ হচ্ছে, সে কারণে আমি আশা করব, এ সময়ে ক্ষতিপূরণ প্রদানের পর্বটি যেন একেবারেই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে দেওয়া হয়।
সকালের খবর : অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন এ দুর্ঘটনায়। তাদের এবং যারা সুস্থ ছিলেন তাদের সহায়তার বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
মোস্তাফিজুর রহমান : যারা বিভিন্নভাবে পঙ্গু হয়েছেন তাদের চিকিত্সাটা খুবই দীর্ঘকালীন। সে ক্ষেত্রে তাদেরও যাতে স্থায়ী একটি আয়ের ব্যবস্থা করা যায় সে দিকটিও দেখতে হবে। বিভিন্ন সংগঠন থেকে তাদেরকে সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের প্রাথমিক যে প্রয়োজন সেটাও হয়তো কিছুটা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের পরিবারের একটা সুনির্দিষ্ট আয়ের ব্যবস্থা করাটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যারা কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়েছিলেন তাদের কাজ দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে-এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তারা আবার যেন আগের মতো আয় করতে পারে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাদেরকেও হয়তো সহায়তা দিতে হতে পারে। রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়ে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বা আমাদের একশন প্ল্যানে যেভাবে বলা হয়েছে সেগুলোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো ইতিবাচক। কিন্তু এসব উদ্যোগ, আরও দ্রততার সঙ্গে, সমন্বিতভাবে এবং কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সকালের খবর : এ ঘটনার পর থেকে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো কি যথেষ্ট মনে করেন?
মোস্তাফিজুর রহমান : গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্টি। যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বিজিএমইএও যুক্ত আছে। সে ক্ষেত্রে তারা বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমরা আশা করব ক্ষতিপূরণ, কর্মসংস্থান, শ্রমিকদের জন্য উন্নততর কর্মপরিবেশ, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন রাইটস-এগুলোর ব্যাপারে বিজিএমইএ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেগুলো তারা দ্রুত বাস্তবায়ন করবে বলে আমি আশা করি এবং অ্যাকশন প্লানসহ অন্যান্য বিষয়ে বিজিএমইএর সদস্যদের যে দায়িত্বের কথা বলা আছে আমরা আশা করব তারা সেগুলো আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করবে। তবে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর থেকে পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখব, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর শুরুতে যেভাবে সব পক্ষ মিলে দুর্গতদের সাহায্যার্থে, তাদের প্রাথমিক চিকিত্সার্থে, এতিম শিশুদের সহযোগিতা করার জন্য যে ধরনের উত্সাহ-উদ্দীপনা বা যে ধরনের আগ্রহ ছিল সে আগ্রহের জায়গায় শুরুর দিকে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছিল। কিন্তু হতাহতদের জন্য যখন দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য-সহযোগিতার দরকার পড়ল তখন দেখা গেল সেই সাহায্য-সহযোগিতাটা অপ্রতুল। অর্থাত্ বিজিএমইএ থেকে শুরু করে সবারই আগ্রহে ভাটা পড়ে। আমরা দেখেছি, শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়েছে। বিজিএমইএর তরফ থেকে বকেয়া মজুরি মেটানো হয়েছিল। এগুলো দিয়ে শ্রমিকদের প্রাথমিক পর্যায়ের যেসব প্রয়োজন ছিল সেগুলো হয়তো মিটে গিয়েছিল। কিন্তু রানা প্লাজা যে ধরনের দুর্ঘটনা এবং এই দুর্ঘটনার কারণে শ্রমিকদের ওপর এর যে বহুমুখী প্রতিক্রিয়া সেটি আসলে এক মাস, দুই মাস, ছয় মাস বা এক বছরের সাহায্য-সহযোগিতার বিষয় নয়। এদের দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য দরকার। কারও কারও জন্য হয়তো সারাজীবনের জন্যও সাহায্য প্রয়োজন। সে প্রেক্ষাপটে যে ধরনের উদ্যোগ, পরিকল্পনা বা সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল সে জায়গাগুলোতে কিন্তু যথেষ্ট মাত্রায় পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।
সকালের খবর : বিদেশি ক্রেতারা বছরে ২৩ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক বাংলাদেশ থেকে কিনে কোটি কোটি ডলার মুনাফা করছে। রানা প্লাজা নিয়ে তাদের ভূমিকা কেমন হওয়া দরকার ছিল?
মোস্তাফিজুর রহমান : আমাদের তৈরি পোশাকের যারা বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক দিক হল-বড় বড় ব্র্যান্ড যারা আছে, বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যারা আছে তারা বাংলাদেশকে বয়কট করে নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করে তারা উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে একটা মনোভাব দেখিয়েছেন। এটা খুবই ইতিবাচক বলে আমি মনে করি এবং সে কারণেই তারা যাতে বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং করেন, বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগ্রহটা যাতে অব্যাহত থাকে সে জন্য তাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে আমাদের সহায়তা দেওয়া খুবই প্রয়োজন। আরা এটা করা দরকার নিজেদের স্বার্থের জন্যই। তবে এখানে তারা যেসব কর্মসূচি নিয়েছে সেগুলোর মধ্যেও একটা সমন্বয় দরকার। বিশেষত আমরা দেখছি, অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স যেসব প্রোগ্রাম নিচ্ছে সেখানে দেখাচ্ছে, কোনো কোনো বায়ার নিজস্ব মতধারা প্রয়োগ করতে চাচ্ছে। এসব জায়গায় যদি সমন্বয় করা হয় তাহলে আমাদের উদ্যোক্তাদের পক্ষে সুবিধা হবে। তারা জানবেন, একটা স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে-এটাকে ফলো করতে হবে।
এছাড়া অনেক ছোট গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের পক্ষে রি-লোকেশন করা, কারখানাগুলোকে খুব বড় ধরনের পুনর্গঠন করা-এগুলো তাদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়সাধ্য বটে। সে দিক থেকে মেজর ব্র্যান্ডরা যদি এ ধরনের কারখানাগুলোকে সহায়তা করতে পারে তাহলে ভালো হয়। প্রথমত, এই পুনর্গঠনের জন্য তাদেরকে যুক্তিসঙ্গত সময় দেওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, এই পুনর্গঠনের কাজে তারা যদি আর্থিকভাবে সহায়তা দিতে পারে বা একটা ফান্ড ক্রিয়েট করে সে ফান্ড থেকে স্বল্প সুদে বা বিনা সুদে তাদেরকে ঋণ দিতে পারে। সেটা যদি বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলে আমার মনে হয় ছোট উদ্যোক্তারা এই ঝড় সামলে নিতে পারবে।
সকালের খবর : রানা প্লাজা-পরবর্তী গার্মেন্ট কারখানা সংস্কারসহ যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো পোশাকশিল্পের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে বলে আপনি মনে করেন?
মোস্তাফিজুর রহমান : এর ফলে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল কারখানাগুলোকে যদি যথাযথভাবে পুনর্গঠন করা যায় তাহলে এ শিল্পের বিরাট উপকার হবে। আমার মনে হয়, প্রত্যেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটা সুযোগও থাকে। বিশ্ববাজারে আমরা যদি বাংলাদেশ ব্র্যান্ডটাকে একটা ভালো ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তাহলে ভালো হয়। বিদেশিরা জানবে, এদেশে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, এখানের কর্মপরিবেশ ভালো, এখানে শ্রমিকদের জীবনধারণের উপযোগী মজুরি দেওয়া হয়। এগুলো যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে এ খাতের উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটবে। এ জন্য আমাদের উচিত হবে এখন আমরা যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করছি এ কর্মসূচিগুলোকে কেবল ব্যয় না ভেবে ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ হিসেবে ভাবি।
সকালের খবর : এত সঙ্কট সত্ত্বেও বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের সামনে আপনি সম্ভাবনা কেমন দেখছেন।
মোস্তাফিজুর রহমান : তৈরি পোশাক খাতের বিশ্ববাজার সাড়ে ৪শ’ বিলিয়ন ডলারের। তার মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলার বা পাঁচ শতাংশ আমরা পূরণ করছি। এ ক্ষেত্রে চীন শতকরা ৩০ ভাগ দখল করে রেখেছে। কিন্তু চীনের এই অংশটা কিন্তু কমে আসছে। সে জায়গাটাতে বাংলাদেশের পক্ষে যদি আমরা ভালোভাবে বিশ্ব দরবারে একটা কমপ্লায়েন্ট দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারি তাহলে আমার মনে হয়, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের এই পাঁচ শতাংশকে সাত-আট শতাংশে নিয়ে যাওয়া এবং আমাদের ২২-২৩ বিলিয়ন ডলারের রফতানি ৪০-৪৫ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি।