Published in The Daily Sangbad on Monday, 20 January 2014.
সাক্ষাৎকারে ড. মুস্তাফিজুর রহমান : সরকারি উদ্যোগ ও স্থিতিশীল থাকলে অর্থনীতির ক্ষতি দ্রুত পুষিয়ে নেয়া যাবে
জাফর আহমদ
টানা সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অর্থনীতিতে হওয়া ক্ষতি কয়েক মাসের মধ্যেই পুষিয়ে নেয়া যাবে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, অস্থিতিশীল রাজনীতির কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে সরকার যে সব উদ্যোগের কথা ঘোষণা করেছে তা সুসমভাবে কাজে লাগালে শীঘ্রই কাটিয়ে ওঠা যাবে। তবে এর জন্য দরকার হবে স্থিতিশীল রাজনীতি। সংবাদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ড. মুস্তাফিজুর রহমান এ সব কথা বলেন। ড. মুস্তাফিজ বলেন, গত কয়েক মাস ধরে যে সহিংসতা দেখলাম তার কারণে অর্থনীতি চাপে ছিল। অর্থনীতির সরবরাহের চেইন ভেঙ্গে গিয়েছিল, বিনিয়োগকারী নিরুৎসাহিত হয়েছে, ব্যাংকগুলোতে তারল্য বাড়ছিল, বেসরকারি খাতে প্রাক্কলন অনুযায়ী বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল না। বেসরকারি খাতের মেয়াদি ঋণও নেতিবাচক হয়ে গিয়েছে। সবমিলে অর্থনীতি একটি চাপের মধ্যে ছিল। ভোক্তা, বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক ও উৎপাদনকারী পর্যায়ে এর একটি বিরূপ প্রভাব পড়েছে। চলতি অর্থবছরের বাকি ৫ মাসে হয়তো এ চাপ সামলানো যাবে না। এ চাপ সামলাতে আরও কয়েক মাস লেগে যাবে।
তিনি বলেন, আগামীতে সহিংস রাজনৈতিক কর্মকা- আর চলবে না; কয়েক মাসে যেভাবে সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন দেখেছি। এর ফলে যারা বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কার্যাদেশ দিতে আসবে তারা আসতে পারছিল না, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছিল না। সর্বপরি একটি অনিশ্চয়তা ছিল। এখন হয়তো গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলবে, আলাপ-আলোচনা চলবে, সহিংসতা হবে না। এমন যদি হয় তাহলে যে ক্ষতি হয়েছে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তার অভিসংযোজন করা সম্ভব হবে। তবে এটা করার জন্য সরকারের কিছু কিছু ইন্টারভেনশনের দরকার হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে রপ্তানির যে সব ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে ছোট-বড় উদ্যোক্তা নির্বিশেষে সুসম বণ্টন করা দরকার বলে মনে করেন ড. মুস্তাফিজ। তিনি বলেন, রপ্তানিকারকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, উৎসে কর দশমিক ৮ শতাংশ ছিল, সেটা কমিয়ে দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে; নতুন বাজার অুনসন্ধানের জন্য যে প্রণদোনা ৩ শতাংশ দেয়া হতো, তা বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। আরও অন্য ক্ষেত্রে সুবিধা হয়তো দেয়া হবে। এসব প্রণদোনা যদি সুসমভাবে করা হয়, যারা বড় তারাও পায়, যারা ছোট তারাও যেন বঞ্চিত না হয়।
বিনিয়োগকে চাঙ্গা করার জন্য যদি মুদ্রানীতি করা হয়- এক্সচেঞ্জ স্ট্যাবল রাখা হয়, ইনফ্লেশন যাতে না বাড়ে, রপ্তানিকে চাঙ্গা করতে নীতি গ্রহণ করা হয়; খাদ্য মজুদ ঠিকমত রাখা দরকার এবং সরকারের যেসব প্রণদোনা আছে এগুলো যদি ঠিকমত দেয়া হয় তাহলে অর্থনীতিকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। বছরের পাঁচ মাসে কতটা করবে এটা কতদূর করা যাবে তা ভাবার বিষয়। তবে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তারপর পুরোটা আবার ট্র্যাকে চলে আসবে। এটা অভিসংযোজন করা সম্ভব হবে বলে তিনি বলেন।
টানা সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের কার্যাদেশ বাইরে চলে গেছে বলে বলা হচ্ছে। এটা আবার কিভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অস্থিতিশীলতার কারণে কার্যাদেশ বাইরে গেছে, এমন কোন তথ্য নেই। এটা সম্ভবও নয়। তবে যেটা হয়েছে তা হলো- ক্রেতারা উদ্যোক্তাদের সতর্ক করে দিয়েছে, সহিংসতা চলতে থাকলে তারা চলে যাবে। হুট করে চলে যাবে- এ কথার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। হঠাৎ করে এটা যেতে পারে না। অস্থিতিশীলতা চলতে থাকলে হয়তো তারা আস্তে আস্তে চলে যায়। কিছু কিছু ‘আপ মার্কেট’ আছে সেগুলো হয়তো চলে যেতে পারে। এটা খুবই সামান্য। এতে মনে হয় না রপ্তানির প্রবণতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, এ অর্থবছরের জন্য রপ্তানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এখনই ১৬/১৭ শতাংশের প্রবৃদ্ধি আছে। বছরের বাকি সময়ে যে রপ্তানি হবে তা ১৩/১৪-এর নিচে নামবে না বলে তিনি মনে করেন। তবে এর জন্য দরকার হবে স্থিতিশীল রাজনীতি।
তিনি বলেন, টানা সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি রপ্তানির সংখ্যাগত কোন পতন হয়নি। তবে খরচ বেড়েছে। এ কারণে তাদের মুনাফার ওপর একটি প্রভাব পড়েছে। এখন পর্যন্ত ক্ষতির জন্য যে সব প্রণদোনা সরকার ঘোষণা করেছে তা কার্যকর শুরু হলে সে প্রভাবও দূর হবে। দরকার শুধু বড় ধরনের কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা না করা।
অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালক হচ্ছে কৃষি। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, হরতাল-অবরোধের কারণে কৃষিতে সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন? সংবাদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় ফসল হচ্ছে বোরো ধান। এ ফসলের জন্য যে ধরনের ইনপুট দরকার হরতাল-অবরোধ-সহিংসতার কারণে সেভাবে দেয়া যায়নি, বীজতলা তৈরি করতে যে ধরনের কাজ হওয়ার কথা ছিল- সেভাবে হয়নি। খাদ্য নিরাপত্তা যাতে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য বোরো চাষে সঠিকভাবে ইনপুট দিয়ে সমস্যা কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
দেশে খাদ্য মজুদের পরিমাণ ৯ লাখ টনে নেমে এসেছে। হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সেদিকে নজর দেয়া সম্ভব হয়নি। খাদ্য নিরাপত্তাকে অব্যাহত রাখতে এদিকেও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. মুস্তাফিজুর রহমান।